১৩০০ বছরের ইসলামের ইতিহাসে 'তারাবীর নামাজ কয় রাকআত?' এটা নিয়ে কোনো মারামারি ছিলো না। মারামারি শুরু হয় গত শতাব্দীতে...
রাতের নামাজ অন্যান্য মাসে যেটা ‘তাহাজ্জুদ’, রামাদ্বান মাসে সেটা ‘তারাবীহ’। তাহাজ্জুদের যে ফযিলত, তারাবীহরও একই ফযিলত। তবে রামাদ্বান মাসে রাতের নামাজ তথা তারাবীহর বিশেষ মর্যাদা রয়েছে।
রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেনঃ “যে ব্যক্তি রামাদ্বানে ঈমানের সাথে সওয়াবের আশায় রাতে নামাজ পড়ে, আল্লাহ তার পূর্বের গুনাহগুলো ক্ষমা করে দিবেন।” [সহীহ বুখারীঃ ৩৭]
এখন আসুন, আমরা জানবো কিভাবে তারাবীহর নামাজের প্রচলন হয়। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাঁর জীবনের শেষ রামাদ্বানে একদিন রাতে মসজিদে যান। একা একা তারাবীহ পড়েন। তিনি কাউকে নামাজ পড়তেও বলেননি। কিন্তু সাহাবীরা তাঁর দেখাদেখি নামাজ পড়ে। পরের রাতে দেখা গেলো সাহাবীদের সংখ্যা আগের চেয়ে বেড়ে গেছে। তৃতীয় রাতে মসজিদে মুসল্লির সংখ্যা আরো বেড়ে যায়। চতুর্থ রাতে মসজিদে তিল ধারণের জায়গা ছিলো না, কিন্তু সেদিন রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) মসজিদে গেলেন না।
ফজরের নামাজ পড়ে তিনি উপস্থিত মুসল্লিদেরকে বললেন, “শোনো, আমি জানতাম তোমরা সারারাত ধরে এখানে আছো, কিন্তু আমি আসিনি। আমি আশঙ্কা করছি, তোমরা মনে করবে এই নামাজ ‘ফরজ’। আর তোমরা তা আদায় করতে অপারগ হয়ে পড়তে পারো।” [সহীহ বুখারীঃ ২০১২]
এরপর রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ইন্তেকাল করেন এবং তারাবীহর বিষয়টি অমিমাংসিত থাকে। আবু বকরের (রাদিয়াল্লাহু আনহু) সময়েও বিষয়টি আলোচনায় আসেনি। উমরের (রাদিয়াল্লাহু আনহু) সময়ে প্রথম বছরে তারাবীহ নিয়ে কোনো কথা উঠেনি।
উমরের (রাঃ) খিলাফতের দ্বিতীয় বছর রামাদ্বানে তিনি মসজিদে ঢুকে দেখেন মুসল্লিরা এলোমেলোভাবে নামাজ পড়ছেন। কেউ একা একা নামাজ পড়ছেন, কেউ ছোটো ছোটো জামাতে নামাজ পড়ছেন। উমর (রাঃ) চাইলেন, সবাই এভাবে এলোমেলো না হয়ে যদি একজন ইমামের পেছনে নামাজ পড়তো।
তখন উবাই ইবনে কা’বকে (রাদিয়াল্লাহু আনহু) উমর (রাঃ) নিযুক্ত করেন তারাবীহর নামাজ পড়ানোর জন্য। সবাই এক জামাতে তারাবীহর নামাজ পড়া শুরু করে। দৃশ্যটি দেখে উমর (রাঃ) বললেন, “কতোই না সুন্দর এই নতুন ব্যবস্থা!” [সহীহ বুখারীঃ ২০১০]
ইতিহাসের বইগুলোতে লিপিবদ্ধ আছে, উমর (রাঃ) পুরুষদের তারাবীহর নামাজের জন্য দুজন ইমাম নিযুক্ত করেন এবং নারীদের নামাজের জন্য আরেকজন ইমাম নিযুক্ত করেন। প্রথমদিকে তারাবীহর নামাজ আট রাকআত পড়া হতো, সাথে তিন রাকআত বিতর। সবমিলিয়ে এগারো রাকআত। কিন্তু, তাঁর খিলাফতের শেষদিকে তিনি আট রাকআতকে বাড়িয়ে বিশ রাকআত করেন। তিন রাকআত বিতরসহ মোট তেইশ রাকআত।
উমর (রাঃ) কেন বিশ রাকআতের প্রচলন করেন? এই প্রশ্নের উত্তর দেন আন্দালুসের বিখ্যাত মালেকী মাজহাবের স্কলার আল-বাজী (রাহিমাহুল্লাহ)। তিনি বলেন, “উমর (রাঃ) এটা মানুষের জন্য সহজ করার জন্য করেন। কারণ, আট রাকআত নামাজ এতো লম্বা হতো যে, মানুষের পায়ে ব্যাথা হতো। দাঁড়িয়ে অনেক্ষণ থাকতে হতো। এজন্য তিনি আট রাকআত থেকে বিশ রাকআত করেন।”
মানুষজন তখন আরেকটা জিনিসের প্রচলন করে। প্রতি চার রাকআত পর তারা কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে আবার নামাজ শুরু করতো। এটার ভিত্তি কী? হাদীসে আছে। আয়িশাকে (রাদিয়াল্লাহু আনহা) রাসূলের (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) রাতের নামাজের বিবরণ জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বর্ণনা করেন, “তিনি চার রাকআত পড়তেন, তারপর বিশ্রাম নিতেন। অতঃপর আবার চার রাকআত পড়তেন। তুমি জিজ্ঞেস করো না তাঁর নামাজ কতোটা সুন্দর ছিলো!” [সহীহ বুখারীঃ ২০১৩]
উমরের (রাঃ) সময় এই হাদীসের উপর ভিত্তি করে তারাবীহর নামাজের মাঝখানে বিশ্রাম নেওয়া হতো, এটাকে আরবীতে বলে ‘তারউইহা’। এই তারউইহা থেকে তারাবীহ এসেছে যার মানে হলো অনেকগুলো ব্রেক-বিশ্রাম।
বিখ্যাত হানাফী ফকীহ ইমাম আল-সারাখসী (রাহিমাহুল্লাহ) তাঁর বিখ্যাত বই ‘আল-মাবসুত’ এ বলেন, ইমাম আবু হানিফা (রাহিমাহুল্লাহ) তারাবীহ শব্দের উৎপত্তির কথা বলতে গিয়ে এই যুক্তির কথা বলেন। অর্থাৎ, বিশ্রাম নেওয়া।
উমর ইবনুল খাত্তাব (রাঃ) কেন বিশ রাকআতই প্রচলন করেন এটার কারণ জানা যায়নি (অর্থাৎ ২০ রাকআতের সংখ্যার পেছনের কারণ)।
খিলাফতের রাজধানী মদীনায় তখন বিশ রাকআত তারাবীহ হয়, মক্কায়ও তখন বিশ রাকআত হয়।
কয়েক বছরের মধ্যে মক্কায় তখন আরেকটি কাজের প্রচলন দেখা দেয়। মক্কার লোকেরা চার রাকআতের মধ্যের ব্রেকে তারা তাওয়াফ করা শুরু করে। অনেকেই বলতে পারেন, এতো কম সময়ের মধ্যে তাওয়াফ করা কিভাবে সম্ভব? এর উত্তরে বলবো, তখন এতো জনসমাগম ছিলো না, হৈ-হুল্লোরও ছিলো না। কম সময়ের মধ্যে তাওয়াফ করা যেতো। আমি (ইয়াসির ক্বাদি) ছাত্রাবস্থায় নিজেও অনেক তাওয়াফ করেছি, যেগুলোতে সময় লেগেছে ১১ মিনিটের মতো কিংবা তারচেয়েও কম।
মক্কার লোকেরা পড়তো বিশ রাকআত তারাবীহ, পাশাপাশি করতে পারতো তাওয়াফ। এই খবরটি যখন মদীনার লোকেরা জানতে পারলো, তারা তখন চিন্তা করলো আমরা তো তাওয়াফ করতে পারবো না! তারা বিশ রাকআতের সাথে আরো ষোলো রাকআত তারাবীহ পড়া শুরু করলো। সবমিলিয়ে ছত্রিশ রাকআত তারাবীহ (তিন রাকআত বিতর মিলিয়ে উনচল্লিশ রাকআত)। এটা ছিলো তাবেঈ, তাবে-তাবেঈদের যুগে।
ইমাম জাফরানী ইমাম আশ-শাফে’ঈকে (রাহিমাহুল্লাহ) তারাবীহর রাকআত সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলে ইমাম শাফে’ঈ বলেন, “আমি মদীনার লোকদেরকে উনচল্লিশ (৩৬+৩) রাকআত পড়তে দেখেছি এবং মক্কার লোকদেরকে তেইশ (২০+৩) রাকআত। তুমি এই দুটো মতের যেকোনো একটা ফলো করতে পারো, কোনো অসুবিধা নেই।”
দেখুন, ইমাম আশ-শাফে’ঈ বলছেন, মক্কার লোকেরা তেইশ রাকআত পড়ে, মদীনার লোকেরা উনচল্লিশ রাকআত, তুমি যেকোনো একটা ‘ফলো’ করলেই হবে। এই পজিশনটি ইসলামের ইতিহাসে ছিলো সবচেয়ে স্ট্যান্ডার্ড পজিশন। অর্থাৎ, একটা পড়লেই হলো।
প্রিয় মুসলিম ভাইয়েরা! তারাবীহ আট না বিশ রাকআত এটা নিয়ে বাড়াবাড়ি করবেন না। আমার জানামতে ইসলামের তেরশো বছরের ইতিহাসে এটা নিয়ে কোনো ঝামেলা ছিলো না। এটা নিয়ে প্রথম ঝামেলা শুরু হয় গত শতাব্দীতে!
গত শতাব্দীর একজন বিখ্যাত মুহাদ্দিস, খুব দক্ষ আলেম (রাহিমাহুল্লাহ) প্রথমবারের মতো দাবী করলেন- বিশ রাকআত তারাবীহ হলো বিদআত! এর আগে আমার জানামতে কেউ এমন দাবী করেননি।
আমার শিক্ষক শায়খ ইবনে উসাইমিন (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, “যে বলে আট রাকআতের বেশি তারাবীহ পড়া বিদআত, সে নিজেই আসলে বিদআত বলছে। কারণ, এর আগে কোনো আলেম এটাকে বিদআত বলেননি।”
তারাবীহর নামাজ কোনো সংখ্যাগত বিষয় বা কোয়ান্টিটি না, এটা হলো কোয়ালিটি। এটা ফরজও না যে কমালে বাড়ালে ক্ষতি হবে। এটা নফল নামাজ। আপনি আপনার ইচ্ছামতো আট রাকআত পড়ুন, বিশ রাকআত পড়ুন কিংবা ছত্রিশ রাকআত।
আমাদের রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) রাতে নামাজ পড়তেন দীর্ঘ সময় নিয়ে। তিনি পড়তেন আট রাকআত। কিন্তু, তিনি আমাদেরকে নির্দেশ দিয়ে যাননি- আট রাকআত পড়তেই হবে।
এমনকি একবার একজন সাহাবী এসে জিজ্ঞেস করলেন, “ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমি রাতের নামাজ কিভাবে আদায় করবো?” রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন, “দুই রাকআত দুই রাকআত করে আদায় করবে। আর যদি আশঙ্কা করো ফজরের সময় হয়ে যাচ্ছে, তখন বিতর পড়া শুরু করবে।” [সহীহ বুখারীঃ ৪৭২]
এই মতটিই ছিলো দীর্ঘ তেরশো বছর ধরে মুসলিম উম্মাহর মত। এই তেরশো বছরে কেউ কখনো বলেনি- বিশ রাকআত তারাবীহ পড়া বিদআত।
সুতরাং, আপনাকে কেউ এসে যদি বলে, “তুমি বিশ রাকআত পড়ছো কেন? তুমি কি জানো না বিশ রাকআত পড়া বিদআত?” তাহলে আপনি জবাবে বলবেন, “জাজাকাল্লাহু খাইরান। আপনি আট রাকআত পড়ুন, যেভাবে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) পড়েছেন।” এন্ড অব স্টোরি। এটা নিয়ে মারামারি করার দরকার নেই।
[লেখাটি শায়খ ইয়াসির ক্বাদির লেকচার থেকে অনূদিত।]
লেকচার লিংকঃ https://bit.ly/2RJElxL
লেখাঃ আরিফুল ইসলাম (আল্লাহ্ তাকে উত্তম প্রতিদান দান করুন!)
আপনিও হোন ইসলামের প্রচারক ইন শা আল্লাহ ’ লেখাটি শেয়ার করুন বন্ধুদের সাথে!
0 Comments