ভয় পেওনা আমি তোমাদের সাথেই আছি

ভয় পেওনা আমি তোমাদের সাথেই আছি

খুব মন খারাপ? হৃদয়ের অন্দরমহলে ভাঙনের জোয়ার? চারপাশের পৃথিবীটাকে বিস্বাদ আর বিরক্তিকর লাগছে? মনে হচ্ছে, আপন মানুষগুলো দূরে সরে যাচ্ছে? হারিয়ে যাচ্ছে প্রিয়জন, প্রিয়মানুষ? কিংবা অযাচিত, অন্যায্য সমালোচনায় ক্ষতবিক্ষত অন্তর? নিন্দুকের নিন্দায় হৃদয়ের গভীরে গভীর দুঃখবোধের প্লাবন? তাহলে চলুন আমরা ঘুরে আসি অন্য একটা জগত থেকে।

বলছিলাম সেই সময়কার কথা যখন পৃথিবীতে রাজত্ব করছিল সবচাইতে নিকৃষ্ট, নির্দয়, নরপিশাচ শাসক ফিরাউন। সম্ভবত, পৃথিবী আর কখনোই তার মতন দ্বিতীয় কোনো যালিম শাসককে অবলোকন করবে না। তার অত্যাচার আর নির্যাতনের মাত্রা ছিল অতি ভয়ংকর। হবেই-বা না কেন? নিজেকে সে ‘খোদা’ দাবি করত। খোদার শান, মান আর মর্যাদার আসনে কল্পনা করে সে নিজেকে জগতের একচ্ছত্র অধিপতি ধরে নিত। তার এই মিথ্যে দাবির সাথে যারাই দ্বিমত করত, তাদের কপালে জুটত — মৃত্যু! সেই মৃত্যুগুলো কোনো সাধারণ মৃত্যু ছিল না। কাউকে আগুনে পুড়িয়ে মারত, কাউকে পানিতে চুবিয়ে মারত। যেন মৃত্যুর বাহারি আয়োজনে ভরপুর থাকত তার সংসদ।

ফিরাউন ধরে ধরে বনি ইসরাইলের পুত্র সন্তানদের হত্যা করত। ফিরাউন জানত, তাকে বধ করার জন্য এই বনি ইসরাইলের মধ্যেই সত্য ইলাহের একজন সত্য নবি প্রেরিত হবে। সে ভাবত, বনি ইসরাইলের ঘরে জন্ম নেওয়া সকল পুত্র সন্তানকে হত্যা করতে পারলেই তার পথের কাঁটা সাফ করে ফেলা যাবে।

এই নিষ্ঠুর, নির্দয় যালিমের হাত থেকে নিজের সন্তানকে বাঁচাতে মরিয়া হয়ে উঠল শিশু মুসার মায়ের অন্তর। চোখের সামনে প্রাণাধিক প্রিয় সন্তানের নির্মম মৃত্যুদৃশ্য অবলোকন করা দুনিয়ার কোনো বাবা-মায়ের পক্ষেই সম্ভব নয়। কীভাবে বাঁচাবেন পুত্রকে তিনি? কীভাবে তাকে আড়াল করবেন যালিম বাহিনীর নাগপাশ থেকে? অস্থির চঞ্চলা হয়ে পড়লেন তিনি। মুসার মায়ের হৃদয়ের এই ব্যাকুলতা আল্লাহর কাছে গোপন থাকল না। তিনি শিশু মুসা আলাইহিস সালামকে একটা বাক্সে ভরে নদীতে ভাসিয়ে দেওয়ার জন্য মুসার মাকে নির্দেশ দিলেন। ব্যাপারটা কুরআনে এসেছে। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা বলছেন, 'আর আমি মুসার মায়ের নিকট এই মর্মে নির্দেশ পাঠালাম যে, তুমি তাকে দুধ পান করাও। অতঃপর যখন তুমি তার ব্যাপারে আশঙ্কা করবে তখন তাকে নদীতে নিক্ষেপ করবে'। [সুরা কাসাস, আয়াত : ০৭]

চিন্তা করুন। একদিকে ফিরাউন বাহিনীর হাত থেকে সন্তানকে প্রাণে বাঁচাতে মায়ের অন্তর মরিয়া। অন্যদিকে বলা হচ্ছে, শিশুটাকে যেন বাক্সবন্দি করে নদীর পানিতে ভাসিয়ে দেওয়া হয়। আপাতদৃষ্টিতে আমাদের মনে হতে পারে, এ যেন মৃত্যুর আগেই মৃত্যুকে বরণ করে নেওয়া। ডাঙার বাঘের ভয়ে জলের কুমিরের সামনে সন্তানকে ঠেলে দেওয়ার মতন ব্যাপার। আমার এবং আপনার মনে যে ভাবনার উদয় হচ্ছে তা কি মুসা আলাইহিস সালামের মায়ের মনেও উদয় হয়নি? হ্যাঁ, হয়েছে। তবে, তার মনের সেই ভীতি, সেই ভয়, সেই সন্দেহ তখনই দূর হয়ে গেল, যখন তিনি আল্লাহর কাছ থেকে আশার বাণী শুনতে পেলেন। সুমহান আল্লাহ বললেন, 'আর একদম ভয় করবে না এবং চিন্তাও করবে না। নিশ্চয়ই আমি তোমার সন্তানকে তোমার নিকট ফিরিয়ে দেবো এবং তাকে রাসুলদের অন্তর্ভুক্ত করব'। [সুরা কাসাস, আয়াত : ০৭]

ওই জায়গায় আমি কিংবা আপনি হলে যে ভয় এবং যে ভীতি আমাদের অন্তরকে আষ্টেপৃষ্ঠে ধরত, একই ভয় মুসা আলাইহিস সালামের মায়ের মনেও জেঁকে বসেছিল। তবে তিনি হতোদ্যম হয়ে যাননি। আশা ছেড়ে দেননি। তিনি চোখমুখ বন্ধ করে এমন এক সত্তার ওপর ভরসা করেছিলেন যার দেওয়া আশা কখনো মিথ্যে হয় না। যিনি কখনোই প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করেন না। এরপর ফলাফল কী হলো তা আমরা সকলেই জানি। মুসা আলাইহিস সালামকে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা রক্ষা করেছিলেন। কেবল রক্ষাই করেননি, যে শত্রু হন্যে হয়ে তাকে হত্যা করার জন্য ওঁৎ পেতে বসে ছিল, সেই শত্রুর অন্দরমহলেই শিশু মুসা আলাইহিসসালামকে আল্লাহ তা'আলা বড় করে তুলেছিলেন। এই পরিকল্পনা কার? কে এমন নিখুঁত পরিকল্পনা করার ক্ষমতা রাখেন? তিনি সুমহান আল্লাহ।

'তারা চক্রান্ত করে আর আল্লাহ কৌশল করেন। নিশ্চয় আল্লাহ সর্বশ্রেষ্ঠ কৌশলী'। [সুরা আলে ইমরান, আয়াত : ৫৪]

আমরা ইয়াকুব আলাইহিস সালামের ঘটনাও স্মরণ করতে পারি। শিশু ইউসুফ ছিলেন পিতা ইয়াকুব আলাইহিস সালামের সবচেয়ে প্রিয় সন্তান। ইউসুফের প্রতি পিতা ইয়াকুব আলাইহিস সালামের এই অবর্ণনীয় ভালোবাসাকে কোনোভাবে মেনে নিতে পারেনি তার অন্য সহোদরেরা। হিংসার বশবর্তী হয়ে, খেলার নাম করে তারা ছোট্ট ইউসুফকে ফেলে দেয় এক অন্ধকার কূপের মধ্যে। পিতা ইয়াকুব আলাইহিস সালামের কাছে এসে তারা খুব সুন্দর কাহিনি ফেঁদে বসল। বলল, ‘বাবা, খেলার মাঠ থেকে ইউসুফকে বাঘ খেয়ে ফেলেছে!’ ইয়াকুব আলাইহিস সালাম জানতেন যে, তার ছেলেরা তার কাছে এসে মিথ্যে কথা বলছে। তিনি এটাও জানতেন যে, তারা নিশ্চিত ইউসুফের কোনো ক্ষতি করে বসেছে। এতৎসত্ত্বেও তিনি কোনো প্রতিশোধ গ্রহণ করলেন না। প্রাণাধিক প্রিয় সন্তানকে হারানোর বেদনায় মাথা চাপড়িয়ে অজ্ঞান হয়ে গেলেন না। এমনকি ছেলেদের তিনি কোনো কটু কথা, কোনো হুমকি-ধমকি পর্যন্তও দিলেন না। তিনি কী বলেছিলেন জানেন? কুরআনে এসেছে, 'সুতরাং, আমার করণীয় হচ্ছে সুন্দর এবং সুস্থিরভাবে ধৈর্যধারণ করা। আর তোমরা আমার কাছে যা বর্ণনা করছ, সে বিষয়ে আল্লাহই হলেন আমার একমাত্র সাহায্যদাতা'। [সুরা ইউসুফ, আয়াত : ১৮]

আল্লাহর ওপর ভরসার পারদ কতটা উঁচুতে থাকলে এমন মুহূর্তে একজন বাবা এ রকম কথা বলতে পারে? এভাবে ধৈর্যের চরম পরীক্ষা দিতে পারে? আর সেই ধৈর্যের বিনিময় কতটা বিশাল ছিল তা তো আমরা জানি। ইউসুফ আলাইহিস সালামকে পরবর্তীকালে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা মিশরে অধিষ্ঠিত করেন রাজার বিশ্বস্ত লোক হিসেবে। যে ভাইগুলো তার সাথে শত্রুতা করে একদিন তাকে কূপে ফেলেদিয়েছিল, তাদেরকেই তিনি তার পায়ের কাছে এনে ফেলেছিলেন। তিনি ইয়াকুব আলাইহিস সালামের কাছে ফিরিয়ে দিয়েছিলেন প্রিয়তম পুত্র ইউসুফকে, আর ইউসুফ আলাইহিস সালামের কাছে ফিরিয়ে দিয়েছিলেন প্রিয়তম পিতাকে। সুবহানাল্লাহ! কত সুন্দর আল্লাহর জুড়ে দেওয়া মেলবন্ধন! কত চমৎকারই-না বিপদে ধৈর্যধারণের ফল!

সুতরাং, দুনিয়াবি কষ্টগুলোতে, ‘না পাওয়া’ ও ‘হারিয়ে ফেলা’ গুলোতে একজন মুমিন কখনোই হতাশ হবে না। চরম বিপদের মুহূর্তে, উভয় সংকটের সময়ে মুসা আলাইহিস সালামের মাতা আল্লাহর দেওয়া ফয়সালাই মাথা পেতে গ্রহণ করেছিলেন এবং অপেক্ষা করেছিলেন আল্লাহর কৃত ওয়াদার ফললাভের জন্য। পুত্র হারানোর শোকের দিনেও নবি ইয়াকুব আলাইহিস সালাম দেখিয়েছেন ধৈর্যের চরম পরাকাষ্ঠা। আল্লাহ তাদের কাউকেই হতাশ করেননি। আন্তরিক সবর এবং আল্লাহর ওপর তায়াক্কুল তথা ভরসা করার জন্য আল্লাহ তাদের উত্তম বিনিময় প্রদান করেছেন। মুসা আলাইহিস সালামের মাতার যিনি রব, তিনি আপনারও রব। যিনি ইয়াকুব আলাইহিস সালামের প্রতিপালক, তিনি আপনারও প্রতিপালক। মুসার মাতা যার ওপরে ভরসা করেছিলেন, আপনিও তাঁর ওপরে ভরসা করুন। ইয়াকুব আলাইহিস সালামের ভরসার কেন্দ্রবিন্দু যেখানে, আপনিও ঠিক সেই জায়গায় আপনার সমস্ত আশা আর ভরসাকে সমর্পণ করুন। যিনি মুসার মাতার অন্তরকে প্রশান্ত করতে পারেন, তিনি কি আপনার ভেঙে খানখান হয়ে যাওয়া হৃদয়ে প্রশান্তির ফল্গুধারা বইয়ে দিতে পারেন না? যিনি মুসা আলাইহিস সালামকে তার চরম শত্রুর ঘরের মধ্যে বড় করে তুলতে পারেন, তিনি কি চাইলে আপনার দুঃখ, আপনার ব্যথা উপশম করে দিতে পারেন না? যে মহান রব মুসার মাতার আর ইয়াকুব আলাইহিস সালামের ভরসার প্রতীক হয়েছিলেন, আস্থার প্রতীক হয়েছিলেন, সেই রবকে আপনিও আপনার সকল আশাভরসার প্রতীক বানিয়ে ফেলুন। জীবনের সমস্ত দুর্যোগে কেবল তাঁর ওপরই ভরসা করুন। দেখবেন আপনার জীবন এক অন্য রকম প্রশান্তিতে ভরে গেছে।

মানুষ হিশেবে আপনার অবশ্যই জানা উচিত — এই দুনিয়া আপনার জন্য কখনোই নির্মল আর নির্ঝঞ্ঝাট হবে না। জীবনের একটা পরম বাস্তবতা হলো জীবন কখনোই রেল লাইনের মতো সমান্তরাল হয় না। এই জীবন হলো দুঃখ-ক্লেশ-কষ্ট দিয়ে গড়া। দুনিয়ার সবাইকে আপনি কখনোই আপনার বন্ধু হিসেবে পাবেন না। সবচাইতে পবিত্র, সবচাইতে তাকওয়াবান ব্যক্তি মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামও তার চারপাশের সবাইকে কখনোই বন্ধু হিসেবে পাননি। তিনি ছিলেন ‘আল-আমিন’ তথা বিশ্বস্ত। সবার কাছে ন্যায় এবং আস্থার প্রতীক হয়ে ওঠা লোকটিরও সমালোচক ছিল। নিন্দুক ছিল। কুৎসা-রটনাকারী ছিল। মানুষের সমালোচনার তীর নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকেও বিদ্ধ করতে ছাড়েনি। নবিজি যখন সমালোচকদের দ্বারা ক্ষতবিক্ষত, যখন তার হৃদয় ভারী হয়ে উঠেছিল মানুষের কটু কথা আর কটু বাক্যে, তখন আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা বললেন, 'আর আমি তো জানি তারা যা বলে তাতে আপনার অন্তর ক্ষতবিক্ষত হয়। সুতরাং, আপনি আপনার রবের প্রশংসায় তাসবিহ পাঠ করুন আর অন্তর্ভুক্ত হোন সিজদাকারীদের'। [সুরা হিজর, আয়াত : ৯৭-৯৮]।স্বয়ং নবিজিকে যেখানে সমালোচনার ভেতর দিয়ে যেতে হয়েছে, সেখানে আপনি বা আমি কীভাবে ধরে নিতে পারি যে, আমাদের সমালোচক থাকবে না? নিন্দুক থাকবে না? আমাদের পেছনে কুৎসা-রটনাকারী থাকবে না? বস্তুত এটাই হলো জীবন! এর জবাবে আমাদের প্রতিউত্তর কী হবে? আল্লাহ শিখিয়ে দিচ্ছেন, তাসবিহ পাঠ এবং সালাত আদায়। এতেই রয়েছে ক্ষতবিক্ষত অন্তরের দুঃখ সারানোর উপশম। ভগ্নহৃদয় পুনর্নির্মাণের মহৌষধ। নবিজিও আল্লাহর বাতলে দেওয়া উপায়েই হৃদয়কে প্রশান্ত করেছেন। মানুষের অযাচিত সমালোচনায় যখন তার হৃদয় বেদনার ভারে নুইয়ে পড়ত, তখন তিনি বিলাল রাযিয়াল্লাহু আনহুকে সালাতের জন্য ডাকতেন আর বলতেন, ‘বিলাল, সালাতের মাধ্যমে আমাদের অন্তরকে প্রশান্ত করো।’ [আবি দাউদ: ৪৯৮৫ (হাদিসটি সহীহ)]

যখন কেউ আপনার নামে কুৎসা রটাবে, অনর্থক আপনার নামে সমালোচনা করবে, তখন আপনি ধৈর্যহারা হবেন না। হতবিহ্বল হয়ে পড়বেন না। সবর করবেন। এই সবরের ফল সুমিষ্ট। আয়িশা রাযিয়াল্লাহু আনহার ব্যাপারে দেওয়া মুনাফিকদের অপবাদের কথা কি মনে আছে? একবার এক সফরের সময়ে তিনি কাফেলা থেকে একটু পিছিয়ে পড়েন। তিনি যে কাফেলা থেকে ছিটকে পড়েছেন সেটা কেউ বুঝতেপারেনি। এরপর, জনশূন্য সেই প্রান্তরে তিনি ঠিক কী করবেন এমন ভাবনার দোলাচলে সময় যেতে লাগল। একসময় তিনি সেখানটায় ঘুমিয়ে পড়েন। পরে, সাফওয়ান ইবনু সুলামি ওই রাস্তা দিয়ে পথ অতিক্রম করার সময় আয়িশা রাযিয়াল্লাহু আনহাকে দেখতে পান এবং তাকে সাথে নিয়ে পুনরায় কাফেলায় যোগ দেন।

এই ঘটনাকে নিয়ে কুৎসা রটিয়ে বেড়ায় মুনাফিকদের সর্দার আব্দুল্লাহ ইবনু উবাই। সে প্রশ্ন তোলে আয়িশা রাযিয়াল্লাহু আনহার পবিত্র চরিত্র নিয়ে! শুনতে অবাক লাগলেও সত্য, মুনাফিকদের এই কুৎসা, এই সমালোচনা এবং তিরস্কার রাসুলসাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এবং আয়িশা রাযিয়াল্লাহু আনহার মাঝে সাময়িক দূরত্বের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। নবিজি বুঝতে পারছিলেন না, সমালোচকদের তিনি কী জবাব দেবেন। কীভাবেই-বা প্রমাণ করবেন যে, আয়িশা একজন সতীসাধ্বী নারী! তাছাড়া, আব্দুল্লাহ ইবনু উবাই যা প্রচার করে বেড়াচ্ছে, তার সত্য-মিথ্যার ব্যাপারেও তিনি সন্দিহান। তিনি কেবল আল্লাহর ওপর ভরসা করলেন। এমন দোটানা পরিস্থিতি, এমন বিপন্ন সময়ে তিনি এক মহামহিম আল্লাহর ওপর তাওয়াক্কুল করেছেন। আয়িশা রাযিয়াল্লাহু আনহাও তা-ই করলেন। কারও সাথে কোনো বিরোধ করেননি। কোথাও উচ্চবাচ্য করেননি। চোখের জল ফেলে কেবল আল্লাহর কাছে নিজের সমস্ত অভিযোগ, সমস্ত বাসনা সোপর্দ করেছেন। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা কি মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কিংবা আয়িশা রাযিয়াল্লাহু আনহাকে নিরাশ করেছেন? হতাশ করেছেন? মুনাফিকদের বিরুদ্ধে, সমালোচনাকারীদের বিরুদ্ধে, কুৎসা-রটনাকারীদের বিরুদ্ধে সাহায্য করেননি? অবশ্যই করেছেন। ওহি নাযিল করে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা আয়িশা রাযিয়াল্লাহু আনহার চরিত্রের ব্যাপারে মুনাফিকদের সকল ষড়যন্ত্রকে নস্যাৎ করে দিয়েছেন। কুরআনে আল্লাহ বলছেন, 'নিশ্চয় যারা এই অপবাদ রটনা করেছে, তারা তোমাদেরই একটি দল'। [সুরা নুর, আয়াত : ১১]

এটা যে একটি অপবাদ, কুৎসা এবং জিঘাংসা, সেটা আল্লাহ সুবহানাহু ওয় তাআলা স্পষ্ট করেই জানিয়ে দিয়েছেন। এভাবেই তো আল্লাহ তার মুমিন ব্যক্তিদের সাহায্য করে থাকেন। কখনো স্পষ্ট সাহায্য, আবার কখনো-বা অস্পষ্ট সাহায্য।

জীবনে আপনিও আপনার চারপাশে একটি দল পাবেন যারা সর্বদা আপনার সমালোচনায় মুখর থাকবে। গভীর পর্যবেক্ষণের দ্বারা আপনার ভালো কাজটির খুঁত বের করবে। আপনার ত্রুটিযুক্ত কাজটিকে ফলাও করে প্রচার করে বেড়াবে যাতে আপনাকে মানসিকভাবে ভেঙে দেওয়া যায়। যাতে আপনি হতাশ হয়ে পড়েন। আপনার মন যাতে বিষিয়ে ওঠে। এ সবকিছুই তারা আপনার প্রতি হিংসা, ঈর্ষা আর জিঘাংসার বশবর্তী হয়ে করে থাকে; কারণ, আপনার অবস্থান তাদের পীড়া দেয়। আপনার গ্রহণযোগ্যতা তাদের মনে বিষাক্ত ফলার মতো আঘাত করে। আপনাকে আপনার অবস্থান থেকে নামিয়ে আনার চিন্তায় তারা সদা বিভোর থাকে — কীভাবে অন্যদের চোখে আপনাকে খাটো করা যায়, কীভাবে অন্যদের মনে আপনার ব্যাপারে সন্দেহের বীজ বুনে দেওয়া যায়। এদের ব্যাপারে কখনোই হতাশ হবেন না। এদের কথায় মন খারাপ করবেন না। ভেঙে পড়বেন না। হতোদ্যম হবেন না। এদের কথা কিংবা বক্তব্যের বিপরীতেপ্রতিক্রিয়া দেখাবেন না। শুধু সবর করবেন। আল্লাহর ওপর ভরসা করে তাদের ক্ষমা করে দেবেন। নিজের এবং তাদের হিদায়াতের জন্য আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করবেন। ব্যস! আপনার কাজ কেবল এতটুকুই। এ রকম অবান্তর সমালোচনায় পতিত হলে নিজের সাথে কথা বলুন। ভেবে দেখুন তো, আপনার ইখলাস আর নিয়ত আপনার কাছে পরিশুদ্ধ মনে হয় কি না? যদি অন্তরের ভেতর থেকে এই কথা প্রতিধ্বনিত হয় যে, ‘আমি তো এই কাজ আল্লাহকে রাজি-খুশি করার জন্যই করেছি’, তাহলে নিশ্চিন্ত মনে আপনার পরবর্তী কাজে মনোযোগ দিন। এ রকম বিশুদ্ধ নিয়তের কারণে ভুল কাজটার জন্যও আপনার আমলনামায় হয়তো সাওয়াব যোগ হয়ে গেছে।

মন খারাপের দিনগুলোতে আল্লাহর সাথে বেশি বেশি কথা বলুন — কুরআন তিলাওয়াতের মাধ্যমে, সালাতের সিজদার মধ্যে। আল্লাহকে বলুন তিনি যেন আপনার অশান্ত মনটাকে প্রশান্ত করে দেন। তাঁকে অনুনয়-বিনয় করে বলুন, বুকের মধ্যে যে কালবৈশাখী ঝড় আপনার মনের উঠোনটাকে তছনছ করে দিচ্ছে, সেই কালবৈশাখী তিনি যেন থামিয়ে দেন। সেখানে যেন রহমতের বারিধারা প্লাবিত হয়। একটিবার নিজের জীবনে কুরআনকে জায়গা করে দিন। দেখবেন, জীবনের গতিপথ কীভাবে পাল্টে যায়। কুরআনের সারনির্যাসকে একবার নিজের জীবনে বাস্তবায়ন করেই দেখুন না। দেখবেন আপনার জীবনটা অন্য রকম এক শীতলতায় ভরে উঠেছে। দুনিয়ার মানুষ যে অন্তর ভেঙে দেয়, আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা সেই অন্তর ভালোবাসার প্রলেপে জোড়া লাগিয়ে দেন।

আপনার মনে হচ্ছে, আপনি ব্যর্থ হয়ে গেছেন, তাই না? মনে হচ্ছে, পৃথিবীটা আপনার জন্য সংকীর্ণ হয়ে গেছে। জীবনের কোনো মানে খুঁজে না পেয়ে হতাশায় নিমজ্জিত আপনার তনুমন, এই তো? কুরআন খুলুন। দেখুন আপনার রব আপনার জন্যই বলছেন, 'অবশ্যই বিশ্বাসীরা সফল হয়েছে'। [সুরা মুমিনুন, আয়াত : ০১]

আপনি একজন মুমিন। একজন বিশ্বাসী। একজন তাকওয়াবান। আপনি তো হতাশ হতে পারেন না। আল্লাহর দয়া থেকে, তাঁর করুণা, ভালোবাসা এবং রহমতের যে বারিধারা আপনার ওপর বর্ষিত হচ্ছে, তা থেকে আপনি কীভাবে নিরাশ হবেন? দুনিয়াবি ব্যর্থতা, অসফলতায় আপনার কী আসে যায়, বলুন? আল্লাহর ওপর যারা ভরসা করে, নির্ভর করে, তারা হতাশ হয় না। দুনিয়ার ব্যর্থতা তাদের আঘাত দেয় না। তারা বরং অপেক্ষার প্রহর গোনে মহাসাফল্যের। সেই সাফল্যের, যার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন স্বয়ং রাব্বুল আলামিন। আপনার হৃদয় যখন আল্লাহর ওপর ভরসায় টইটম্বুর, তখন সিজদায় যাকারিয়া আলাইহিস সালামের মতো করে বলুন, 'হে আমার রব! আমি তো কখনো তোমাকে ডেকে ব্যর্থ হইনি'। [সুরা মারইয়াম, আয়াত : ০৪]

আপনার জীবনে অনেক দুঃখ আসতে পারে। আপনি মুখোমুখি হতে পারেন নানান ঝঞ্ঝাক্ষুব্ধ ঝড়ের। কোনো কোনো ঝড়ো হাওয়া এসে আপনার জীবনটাকে এলোমেলো করে দিয়ে যাবে। অস্ফুট স্বরে রবকে যখন বলেন, ‘মালিক! আমার জীবনে এত কষ্ট কেন?’ তিনি তখন বলেন, 'নিশ্চয় কষ্টের সাথেই রয়েছে স্বস্তি'। [সুরা ইনশিরাহ, আয়াত : ০৬]

এমন কঠিনতর বিপদে আশেপাশে কাউকে পাচ্ছেন না। এমনকি অন্ধকারে আপন ছায়াটাও মিলিয়ে যায়। আপনার এতদিনের সুহৃদ, প্রিয় বন্ধু, প্রিয় স্বজনদের কেউই এই দুর্দিনে আপনার পাশে নেই। নিজেকে খুব একা মনে হচ্ছে। মনে হচ্ছে, অকূল দরিয়ায় একটি ডুবুডুবু নৌকার আপনি একাই যাত্রী। এই নৌকা যেকোন মুহূর্তেই তলিয়ে যাবে। এমন সময়ে আপনি যখন আশাহত হয়ে রবের কাছে ফরিয়াদ করে বলেন, ‘মাবুদ! আজকে আমাকে সাহায্য করার মতন কেউই নেই।’ তখন আপনার রব বলেন, 'মুমিনদের সাহায্য করা আমার দায়িত্ব'। [সুরা রুম, আয়াত : ৪৭]

প্রিয়জনেরা বিচ্ছেদ ঘটিয়ে দূরে চলে গেছে। জীবন নামক চোরাবালির সাথে আপনিআর কোনোভাবেই পেরে উঠছেন না। খুব অসহায়বোধ করছেন। মনে হচ্ছে, আপনি এক্ষুনি ডুবে যাবেন দুঃখের অতল গহ্বরে। হারিয়ে যাবেন চিরতরে। তখন যদি মুখ ফুটে বলেন, ‘আল্লাহ! আমার পাশে আজ কেউই আর অবশিষ্ট নেই।’ তখন আপনার ডাক শুনে আল্লাহ বলেন, 'ভয় পেয়ো না! আমি তোমাদের সাথেই আছি। আমি সব শুনি এবং দেখি'। [সুরা ত-হা, আয়াত : ৪৬]

পাপে জর্জরিত হয়ে আছে জীবন। চোখ মেললেই চারদিকে কেবল অন্ধকারের ঘনঘটা দেখতে পান। কলুষিত হৃদয় নিয়ে যখনই আল্লাহর দরবারে দাঁড়িয়ে বলেন, ‘আমি যে এত পাপ করেছি, আল্লাহ কি সত্যিই আমাকে ক্ষমা করবেন?’ তখনই আপনার রব জবাব দেন, 'নিশ্চয় আল্লাহ তাওবাকারীদের ভালোবাসেন'। [সুরা বাকারা, আয়াত : ২২২]

এভাবেই আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা প্রতিটি সময়ে, প্রতিটি মুহূর্তে আপনার পাশে থাকেন। আল্লাহর কালামকে, তাঁর বাণীকে জীবনে ধারণ করুন। আল্লাহকে জীবনে বন্ধু বানিয়ে নিন। বিশ্বাস করুন, বন্ধু হিসেবে তাঁর চেয়ে উত্তম, তাঁর চেয়ে প্রতিশ্রুতিশীল, তাঁর চেয়ে মহান আর কেউ হতেই পারে না। নিজের জীবনের অন্ধকার প্রকোষ্ঠে আলোর রেখা প্রবেশ করতে দিন। অন্ধকারকে আলো দ্বারা দূরীভূত করুন। আপনার যে পৃথিবী এতদিন এক ঘনঘোর আঁধারে নিমজ্জিত ছিল তা উদ্ভাসিত হবে সম্পূর্ণ নতুন এক রূপে। নতুন এক রঙে। মন খারাপের দিনগুলোতে আল্লাহকে আপনার সঙ্গী বানান, দেখবেন সে মুহূর্তগুলো সব আচমকা আপনার জীবনের সেরা মুহূর্তে পরিণত হয়ে গেছে। তাই যে দুঃখগুলোর কথা কাউকে বলতে পারছেন না, যে দুশ্চিন্তার অনলে আপনি দগ্ধ হচ্ছেন প্রতিদিন, যে ভয় আপনাকে তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে অহরহ, হারানোর যে বেদনা আপনাকে কুরে কুরে খাচ্ছে, যে অস্থিরতা আপনাকে ঘুমোতে দিচ্ছে না, যে ভগ্ন হৃদয় আপনাকে ভেঙে খানখান করে দিচ্ছে, সে সমস্ত মন খারাপের গল্পে কেবল বলুন, ‘হাসবুনাল্লাহু ওয়া নি’মাল ওয়াকিল।’ আমার জন্য আমার আল্লাহই যথেষ্ট।

বিশ্বাস করুন, আপনার সমস্ত মনখারাপের উপশমের জন্য কেবল এটুকুই যথেষ্ট। আল্লাহ যার অভিভাবক, কপালে তার দুশ্চিন্তার ভাজ থাকতেই পারে না।

মূলঃ 'বেলা ফুরাবার আগে'
সমাপ্ত

লেখাঃ আরিফ আজাদ (আল্লাহ্‌ তাকে উত্তম প্রতিদান দান করুন!)

আপনিও হোন ইসলামের প্রচারক ইন শা আল্লাহ ’ লেখাটি শেয়ার করুন বন্ধুদের সাথে!

Post a Comment

1 Comments