সতের রামাদান। প্রথম বিজয়ের গল্প।


'হে আল্লাহর বান্দারা, নামাযের সময় হয়েছে!' সুবহে সাদিকের সময় ভেসে আসে পবিত্র রাসূলের আওয়াজ। একটি বৃক্ষের কাছে দাঁড়িয়ে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সকলকে নিয়ে নামায আদায় করেন।

ধীরে ধীরে অন্ধকার তাড়িয়ে উপস্থিত হয় আলো ঝলমল সকাল। সকালের স্নিগ্ধতা মরু দুনিয়ায় খুবই অল্প সময় স্থায়ী হয়। কিন্তু আজকের সকালে যেন স্নিগ্ধতার সামান্য ছোঁয়াও নেই। বদর প্রান্তরে অস্থিরতা। দূর থেকে মৃত্যু নিষ্ঠুরের মতো ঢংকা বাজিয়ে বাজিয়ে এগিয়ে আসছে। কার জীবনের শেষ দিন আজ? সুস্বাগতম জানিয়ে ডানাওয়ালা ফেরেশতা কাকে নিয়ে যাবে জান্নাতী জগতে! কার আত্মাকে ধিক্কার দিয়ে নিক্ষিপ্ত করা হবে আগুনের অতলে!

ভোরের আলো ফুটার পর টিলার ওপাশ থেকে এ পাশে এসে সমবেত হয় কুরাইশরা। তাদের একদল এগিয়ে আসে মুসলিম বাহিনীর কাছাকাছি দখলকৃত হাউযের দিকে। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর যোদ্ধাদের বললেন, ‘তাদেরকে তোমরা কেউ কিছু বলো না!'

তাদের নেতা আবু জাহল মুসলমানদের শক্তি পরিমাপ করার জন্যে উমাইর ইবনে ওয়াহাব জুমাহীকে প্রেরণ করে। উমাইর এক চক্কর দিয়ে ফিরে গিয়ে জানায়, ‘মুসলমানদের সৈন্য সংখ্যা তিনশত বা তার কিছু কম বেশী হবে।’ তারপর আবার বেশ কিছুদূরে ঘোড়া ছুটিয়ে ফিরে এসে উমাইর বলে, তাদের সহায়ক কোন সৈন্য মুসলমানরা পেছনে রেখে আসেনি। তবে একটা ব্যপার লক্ষ্য করেছি যে, ইয়াসরিবের উটগুলো নির্ভেজাল মৃত্যু বহন করে নিয়ে এসেছে। ওদের সমুদয় শক্তি তলোয়ারের উপর নির্ভরশীল। আল্লাহর শপথ, আমি যা বুঝেছি, এতে মনে হয়েছে যে, ওরা কেউ তোমাদের না মেরে মরবে না। যদি তোমাদের বিশিষ্ট লোকদের ওরা মেরেই ফেলে, তবে তোমরা বিশিষ্ট সঙ্গীহারা হয়ে যাবে। কাজেই যা কিছু করবে, আরেকবার ভালো করে ভেবে নাও।'

যুদ্ধ না করেই মক্কায় ফিরে যাওয়ার জন্য আবু জাহলের বিরোধিতা করল হাকিম ইবনে হিযাম। সে এখানে ওখানে ছুটোছুটি করে বুঝাতে শুরু করল। প্রথমে গেল উতবা ইবনে রবীআর কাছে। বলল, ‘হে আবুল ওলীদ, আপনি কোরায়শদের বিশিষ্ট ব্যক্তি। আপনার আনুগত্য সবাই বিনাবাক্যে মেনে নেয়। আপনি শেষ সময়ে একটি ভালো কাজ করুন। এর ফলে সব সময় আপনার আলোচনা মানুষের মুখে মুখে থাকবে।'
উতবা বললো, কী কাজ হাকিম?
হাকিম বললো, 'আপনি আপনার লোকদের ফিরিয়ে নিয়ে যান। আর নাখলার ছারিয়্যায় নিহত আপনার মিত্র আমর ইবনে হাযরামীর ব্যাপারটি আপনি নিজের ওপর নিন।'
উতবা বলল, ‘আমি রাযি আছি। কিন্তু তুমি এ ব্যাপারে যিম্মাদার থাকবে সে আমার মিত্র। তার মৃত্যুর ক্ষতিপূরণের দায়িত্ব আমার উপরই বর্তায়। তার যে সম্পদ বিনষ্ট হয়েছে, আমি তারও যিম্মাদার।'

এরপর উতবা হাকিম ইবনে হিযামকে বলল, 'তুমি হানজালিয়ার ছেলের কাছে যাও। কোনো সুস্থ মতামত ও সিদ্ধান্তের বিপরীতে মানুষের মস্তিষ্ক বিগড়ে ফেলতে ও তাদের মন ঘুরিয়ে দিতে তারচেয়ে অধিক আশংকা আমি আর কারও কাছ থেকে করি না।'

এরপর উতবা ইবনে রবীআ দাঁড়িয়ে কোরাইশদের মধ্যে বক্তৃতার ভঙ্গিতে নিজের মত তুলে ধরে।

আর হাকিম ইবনে হিযাম হানযালিয়্যার ছেলে আবু জাহলের কাছে গিয়ে দেখলেন সে নিজেদের বর্ম পরিস্কার করছে। হাকিম তাকে উতবার পয়গাম শুনালেন। শুনেই আবু জাহল রেগে গেল। বলল, ‘খোদার কসম! মুহাম্মদ এবং তার সঙ্গীদের দেখে উতবার বুক শুকিয়ে গেছে। কিন্তু আমি কিছুতেই মক্কায় ফিরে যাব না। খোদাতায়ালা মুহাম্মদ এবং আমাদের মধ্যে একটা ফয়সালা না করা পর্যন্ত আমরা মক্কায় ফিরে যাব না। উতবা যা কিছু বলেছে, সেটা এ জন্যেই বলেছে যে, সে মুহাম্মদ এবং তার সঙ্গীদের ভয়ে ভীত হয়ে পড়েছে। উতবার পুত্রও মুসলমানদের সঙ্গে রয়েছে এ কারণে সে ওদের ব্যাপারে তোমাদের ভয় দেখাচ্ছে!'

উতবা এই কথাগুলো যখন শুনল তখন বলল, ‘আবু জেহেল শীঘ্রই জানতে পারবে যে, কার বুক শুকিয়ে গেছে, আমার না তার!'

আবু জাহল উতবার এই প্রতিক্রিয়ার খবরে ভয় পেয়ে গেল। সে নাখলার ছারিয়্যায় নিহত আমর বিন হাযরামির ভাই আমের বিন হাযরামিকে ডেকে পাঠালো। সে আসলে আবু জাহল উসকে দেয়ার জন্য বলল, ‘তোমাদের মিত্র উতবা লোকদের ফিরিয়ে নিতে চায়। অথচ তোমাদের চোখেমুখে আজও প্রতিশোধের আগুন জ্বলছে। নিজেদের ওপর অত্যাচার ও ভাতৃহত্যার প্রতিশোধ নাও!'

একথা শুনে আমর উঠে দাঁড়ালো এবংরীতি অনুযায়ী নিজের পরিধেয় বস্ত্র ছিঁড়ে চিৎকার করতে বলতে শুরু করল- ‘হায় আমর! হায় আমর! হায় আমর!’ এই চিৎকার শুনে সবাই জড়ো হলো। লোকজন উত্তেজিত হয়ে উঠল। মুসলমানদের কাছ থেকে প্রতিশোধ গ্রহনের ব্যপারে সবাই প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হলো। উতবা যে আহব্বান জানিয়েছিল, সেটা ব্যর্থ হলো। এমনি করে হুশের ওপর জোশ জয়ী হলো, যুদ্ধ না করার চেষ্টা ব্যর্থ হয়ে গেল।

অমুসলিমরা দলে দলে বেরিয়ে এল এবং উভয় বাহিনী পরস্পরের মুখোমুখি দাঁড়াল।

রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আল্লাহর দরবারে হাত তুলে বললেন, ‘হে আল্লাহ তায়ালা, কুরাইশরা পরিপূর্ণ অহংকারের সাথে তোমার বিরোধিতায় এবং তোমার রসূলকে মিথ্যা প্রমাণ করতে এগিয়ে এসেছে। হে আল্লাহ তায়ালা, আজ তোমার প্রতিশ্রুত সাহায্যে বড় বেশি প্রয়োজন। হে আল্লাহ তায়ালা,তুমি আজ ওদের ছিন্ন ভিন্ন করে দাও!'

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উতবাকে তার লাল উটের ওপর দেখে বললেন, 'কওমের কারো কাছে যদি কল্যাণ থাকে তবে লাল উটের আরোহীর কাছে রয়েছে। অন্যরা যদি তার কথা মেনে নিত, তবে সঠিক পথ প্রাপ্ত হতো।’

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মুসলমানদের কাতারবন্দী করতে শুরু করলেন। তাঁর হাতে ছিল একটি তীর। সেটির সাহায্যে তিনি কাতার সোজা করছিলেন।সাওয়াদ ইবনে গাযিয়া কাতার থেকে একটুখানি সামনে এগিয়ে এলে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হাতের তীর দিয়ে তাঁর পেটে সামান্য খোঁচা দিয়ে বললেন, ‘সাাওয়াদ! সোজা হয়ে দাঁড়াও!'

সাওয়াদ তাৎক্ষনাৎ বললেন, 'হে আল্লাহর রসূল! আপনি আমার পেটে খোঁচা দিয়েছেন, আমি ব্যথা পেয়েছি। আমাকে প্রতিশোধ নিতে দিন!’ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিজের পেটের উপর থেকে জামা সরিয়ে বললেন, ঠিক আছে, প্রতিশোধ নাও। প্রতিশোধ নেয়ার মহা সুযোগ। সাওয়াদ প্রিয় রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে জড়িয়ে ধরে তাঁর পবিত্র পেটে চুম্বন করলেন এবং বললেন, ‘হে আল্লার রসূল, মনে হয় এটাই শেষ সাক্ষাৎ!'

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সাওয়াদের কল্যাণের জন্য দোয়া করলেন।

কাতার সোজা করার পর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সাহাবীদের বললেন, তাঁর পক্ষ থেকে নির্দেশ পাওয়ার আগে কেউ যেন যুদ্ধ শুরু না করে। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এরপর যুদ্ধ পদ্ধতি সম্পর্কে বিশেষ পথনির্দেশ প্রদান করেন। তিনি বললেন, পৌত্রলিকরা যখন দলবদ্ধভাবে তোমাদের কাছে আসবে, তখন তাদের প্রতি তীর নিক্ষপে করবে। তীরের অপচয় যেন না হয়, সেদিকে লক্ষ্য রাখবে। তোমাদের ওপর তারা ঝাঁপিয়ে পড়ার আগ পযর্ন্ত তরবারি চালনা করবে না।

প্রয়োজনীয় নির্দেশ দিয়ে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হযরত আবু বকর রাযিয়াল্লাহু আনহুকে সঙ্গে নিয়ে নিজের অবস্থান কেন্দ্রে চলে গেলেন। হযরত সাদ ইবনে মুআয রাযিয়াল্লাহু আনহু পাহারাদার সৈন্যদের সঙ্গে নিয়ে প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পাহারায় নিযুক্ত হলেন।

অন্যদিকে মুশরিক আবু জাহল আল্লাহর কাছে ফয়সালার জন্যে দোয়া করতে থাকল। তার দোয়ার প্রতি ইঙ্গিত করে আল্লাহ রব্বুল আলামীন কোরআনে বলেন, ‘তোমরা মীমাংসা চেয়েছিলে, তা-তো তোমাদের কাছে এসেছে। যদি তোমরা বিরত হও, তবে সেটা তোমাদের জন্যে কল্যাণকর, যদি তোমরা পুনরায় তা করো, তবে আমিও তোমাদের শাস্তি দেবো এবং তোমাদের দল অধিক হলেও তোমাদের কোনো কাজে আসবে না এবং আল্লাহ তায়ালা মোমেনদের সঙ্গে রয়েছেন।’ [সূরা আনফাল, আয়াত ১৯]

টানটান উত্তেজনা। এক হাজার যোদ্ধার মুখোমুখি মাত্র তিনশো যোদ্ধা। পিতা-পুত্রের বিরুদ্ধে। ভাই-ভাইয়ের বিরুদ্ধে। চাচা-ভাতিজার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে আছে। সত্য আজ মিথ্যার মুখোমুখি হয়েছে।

যুদ্ধের প্রথম ইন্ধন দেয় আসওয়াদ ইবনে আবদুর আসাদ মাখযূমি। এই লোকটি দারুণ সাহসী কিন্তু দুর্বৃত্ত এবং অসৎ চরিত্রের অধিকারী। ময়দানে বেরোতে বেরোতে সে বলে, আমি আল্লাহর সাথে ওয়াদা করছি যে, ওদের হাউজের পানি পান করবো, নতুবা সেই হাউজকে ধ্বংস করবো অথবা তার সামনে প্রাণ বিলিয়ে দিব!'

আসওয়াদ এগিয়ে এল। অন্যদিকে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাহাবীদের মধ্যে থেকে হযরত হামযা ইবনে আবদুল মুত্তালিব এগিয়ে এলেন। জলাশয়ের কাছে উভয়ের মুখোমুখি প্রতিদ্বন্দ্বিতা হলো। হযরত হামযা রাযিয়াল্লাহু আনহু তলোয়ার দিয়ে এমন ভাবে আঘাত করলেন যে, কাফের আসওয়াদের পা হাঁটুর নীচে দিয়ে কেটে দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল। সে ধপাস করে মাটিতে পড়ে গেলো। কর্তিত পা থেকে অবিরাম ধারায় রক্ত বেরোতে লাগল। সেই রক্তধারা তার সঙ্গীদের দিকে প্রবাহিত হচ্ছিল। আসওয়াদ হামাগুড়ি দিয়ে জলাশয়ের দিকে অগ্রসর হচ্ছিল। জলাশয়ের কাছে পৌছে জলাশয়ের পানি পান করে তার কসম পূর্ণ করতে চাচ্ছিল। এমন সময় হযরত হামযা রাযিয়াল্লাহু আনহু আসওয়াদের ওপর পুনরায় আঘাত করলে সে জলাশয়ের ভেতর পড়ে মরলো।

আসওয়াদ ইবনে আবুল আসাদের হত্যার পর যুদ্ধের আগুন পুরো ময়দানে ছড়িয়ে পড়ল। মুশরিক বাহিনীর মধ্য থেকে একই গোত্রের তিনজন বিশিষ্ট যোদ্ধা বেরিয়ে এল। দুই ভাই উতবা বিন রবীআ ও শায়বা বিন রবীআ এবং উতবার পুত্র ওলীদ। এরা কাতার থেকে বেরিয়ে এসে প্রতিপক্ষকে মোকাবেলার জন্যে আহব্বান জানাল। আওফ, মুয়ায়েয ও আবদুল্লাহ ইবনে রাওয়াহা নামে তিনজন আনসার যুবক অগ্রসর হলেন। আওফ ও মুয়ায়েজ দুই ভাই। তারা মোট সাতভাই যুদ্ধে অংশ নিয়েছেন।

কুরাইশরা জিজ্ঞাসা করল, আপনাদের পরিচয় কী? তারা বললেন, আমরা মদীনার আনসার। কুরায়শরা বলল, আপনারা শক্তিশালী প্রতিদ্বন্দ্বী সন্দেহ নেই। কিন্তু আপনাদের সাথে আমাদের কোনো বিরোধ নেই। আমরা চাই আমাদের চাচাতো ভাইদের। এরপর তিন কুরাইশ চিৎকার করে বলল, ‘হে মুহাম্মদ, আমাদের কাছে আমাদের রক্তসম্পর্কীয়দের পাঠাও।'

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, উবাইদা ইবনে হারেস, হামযা, এবং আলী এগিয়ে যাও। এরা এগিয়ে যাওয়ার পর তিনজন কুরাইশ যুবক তাদের পরিচয় জিজ্ঞাসা করল, যেন তারা তাদের চিনে না! তারা নিজেদের পরিচয় দিলেন। কুরাইশরা বলল, হ্যাঁ এবার ঠিক আছে, আপনারা অভিজাত প্রতিদ্বন্দ্বী। শুরু হয় ছয়জনের লড়াই। হযরত উবাইদা ইবনে হারেস রাযিয়াল্লাহু আনহু উতবা ইবনে রবীআার সাথে, হযরত হামযা রাযিয়াল্লাহু আনহু শায়বার সাথে এবং হযরত আলী রাযিয়াল্লাহু আনহু ওলীদ ইবনে উতবার সাথে মোকাবেলা করলেন।

হযরত হামযা এবং হযরত আলী নিজ নিজ প্রতিদ্বন্দ্বীদের কাবু করে ফেললেন কিন্তু হযরত উবাইদা ইবনে হারেস এবং তার প্রতিদ্বন্দ্বী উতবার মধ্যে আঘাত বিনিময় হলো। তারা একে অন্যকে মারাত্বকভাবে আহত করে ফেললেন। ইতিমধ্যে হযরত হামযা এবং হযরত হযরত আলী তাদের প্রতিদ্বন্দ্বীর কাজ শেষ করে হযরত উবাইদার সাহায্যে এগিয়ে এলেন এবং উতবার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে তাকে শেষ করে ফেললেন। হযরত উবাইদা রাযিয়াল্লাহু আনহুর পা থেকে রক্ত পড়ছিল। তারা হযরত উবাইদাকে উঠিয়ে নিয়ে এলেন।

পৌত্তলিকদের দুর্ভাগ্যের সূচনা হলো। একসাথে তিনজন বিশিষ্ট যোদ্ধাকে তারা হারালো। ক্রোধে দিশাহারা হয়ে বর্মে সুসজ্জিত শতশত সৈন্য তলোয়ার নিয়ে একত্রে ঝাঁপিয়ে পড়ল মুসলমানদের উপর।

মুসলমানরা তাদের মহান প্রতিপালকের কাছে সাহায্যের জন্যে দোয়া করে দৃঢ়তার সাথে কাফেরদের হামলা মোকাবেলা করতে লাগলেন। তারা আল্লাহর নাম নিয়ে বিধর্মী কাফেরদের ওপর পাল্টা হামলা চালালেন।

তরবারির ঝনঝন আর সৈনিকদের গর্জন চিৎকারে কেঁপে উঠলো চারদিক। দয়ার নবীজি সর্বশক্তিমান আল্লাহর দরবারে সাহায্য কামনা করে সিজদায় পড়ে গেলেন। শতশত. সৈন্যর মুখোমুখি তাঁর সামান্য সংখ্যক সৈন্য। তিনি আল্লাহর দরবারে ফরিয়াদ করলেন, ‘হে আল্লাহ তায়ালা, আমি আপনার কাছে আপনার প্রতিশ্রুত সাহায্যের আবেদন জানাচ্ছি।'

অতিশয় বিনয় ও নম্রতার সাথে সকাতর কন্ঠে বললেন, ‘হে আল্লাহ রব্বুল আলামীন, যদি আপনি চান তবে আপনার ইবাদত চিরতরে বন্ধ হয়ে যাবে।'
তিনি কখনো সিজদায় মাথা ঠেকিয়ে, কখনো হাত তুলে দোয়া করতেই থাকলেন। আলী রাযিয়াল্লাহু আনহু লড়াইর ফাঁকে ফাঁকে কিছুক্ষণ পরপর যতবার রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের দরবারে এলেন, দেখলেন তিনি সিজদায় পড়ে রয়েছেন।

আল্লাহর দরবারে আকুল হয়ে ফরিয়াদের সময় তাঁর কাঁধ থেকে চাদর পড়ে গেল। হযরত আবু বকর রাযিয়াল্লাহু আনহু রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের চাদর ঠিক করে দিলেন এবং তাঁর কাতর অবস্থা দেখে বললেন, ‘হে আল্লাহর রসূল, যথেষ্ট হয়েছে। নিশ্চয়ই আপনার প্রতিপালক তাঁর কৃত অঙ্গীকার পূর্ণ করবেন!'

মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিন তাঁর হাবীবের ফরিয়াদ গ্রহণ করে প্রতিশ্রুত সাহায্য পাঠিয়ে দিলেন। আকাশ থেকে নেমে এলেন আল্লাহর ফেরেশতারা।

কিছুক্ষণের জন্য তন্ময় হয়ে রইলেন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম। তারপর মাথা তুলে বললেন, ‘আবু বাকর! সুসংবাদ গ্রহণ করো! আল্লাহর সাহায্য এসে গেছে! ঐ দেখো জিবরীল তাঁর ঘোড়ার লাগাম ধরে নিয়ে আসছেন আর তাঁর চারপাশে ধুলোবালি উড়ছে!'৭.

এরপর বর্ম পরিহিত অবস্থায় রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাবুর বাইরে এলেন। তিনি সামনে অগ্রসর হতে হতে বললেন, ‘এই দল শীঘ্রই পরাজিত হবে এবং পৃষ্ঠ প্রদর্শন করবে।’ [সূরা কামার, আয়াত ৪৫]
এরপর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এক মুঠো ধূলি হাতে নিয়ে কাফেরদের প্রতি নিক্ষেপ করে বললেন, ‘শাহাতিল উজুহ’ ওদের চেহেরা আচ্ছন্ন হোক।

রাহমানুর রাহীম সাহায্যে নিক্ষিপ্ত ধূলির কণা প্রত্যেক কাফেরের চোখ, মুখ, নাক ও গলায় প্রবেশ করল। তাদের মনে ভীতি সঞ্চারিত হলো।

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মুসলিম যোদ্ধাদের জবাবী হামলার নির্দেশ এবং যুদ্ধের তাগিদ দিয়ে বললেন, তোমরা এগিয়ে যাও। সেই সত্তার শপথ যাঁর হাতে মুহাম্মদের প্রাণ, ওদের সঙ্গে তোমাদের যে কেউ দৃঢ়তার সাথে পুণ্যের কাজ মনে করে অগ্রগামী হয়ে পেছনে সরে না এসে যুদ্ধ করবে এবং মারা যাবে, আল্লাহ তায়ালা তাকে অবশ্যই জান্নাত দান করবেন।’

যুদ্ধের আসল অস্ত্র হলো হৃৎপিণ্ড, কাফেরদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে মুসলমানের হৃদয় উদ্বুদ্ধ করে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আরো বললেন, ‘সেই জান্নাতের প্রতি ওঠো যার দিগন্ত ও বিস্তৃতি আকাশ ও মাটির সমপরিমাণ।’ একথা শুনে উমায়ের ইবনে হাম্মাম বলে উঠলেন, বাহ, বাহ!
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁকে ‘বাহ’ বলার কারণ জিজ্ঞেস করলে তিনি বললেন, ‘হে আল্লাহর রাসূল, অন্য কোন কারণে নয়, আমি আশা করেছিলাম যে, আমিও যদি সে জান্নাতের অধিবাসী হতে পারতাম।
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, ‘সেসব জান্নাতীদের মধ্যে তুমিও রয়েছো।'
উমায়ের ইবনে হাম্মাম কয়েকটি খেজুর বের করলেন খাওয়ার জন্য। কিন্তু হঠাৎ উচ্ছ্বসিতকন্ঠে বললেন, ‘এই খেজুরগুলো খেতে অনেক সময় প্রয়োজন। জীবনকে এত দীর্ঘায়িত কববো কেন! তিনি খেজুর ছুঁড়ে ফেললেন এবং যুদ্ধরত সৈন্যদের কাতারে মিশে লড়াই করতে করতে শহীদ হয়ে গেলেন।

যখন শত্রুদের ওপর হামলার তীব্রতা কমে গেল, তখন রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম জবাবী হামলার নির্দেশ দেন। তাঁদের উৎসাহ-উদ্দীপনাতে ভাটা পড়েছিল, কিন্তু হামলার নির্দেশে অবস্থান আবার দৃঢ় হয়। সাহাবায়ে কেরাম এসময় কাফেরদের কাতার এলোমেলো করে তাদের শিরচ্চেদ করতে করতে এগিয়ে যান। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিজে বর্ম পরিধান করে রণক্ষেত্রে আছেন দেখে সাহাবাদের উদ্দীপনা আরো বেড়ে যায়। তারা বীর বিক্রমে লড়াই অব্যাহত রাখেন। এসময় ফেরেশতারাও সাহায্য শুরু করেন।

যোদ্ধাদের শোরগোল আর আহতদের চিৎকারে মুশরিকদের জন্য হঠাৎ বিভীষিকাময় হয়ে উঠে বদর প্রান্তর। মুশরিক সৈন্যদের মাথা কেটে পড়ছে অথচ বোঝা যাচ্ছে না, কে তাকে মেরেছে! মুশরিকদের হাত কেটে দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে যাচ্ছে, অথচ কে তাদের হাত কেটেছে তা বোঝা যাচ্ছে না!

একজন আনসারী মুসলমান একজন মুশরিককে দৌড়াতে শুরু করলেন। হঠাৎ চাবুকের আঘাতের শব্দ শোনা গেল। একজন অদৃশ্য থেকে তাঁর ঘোড়াকে সম্বোধন করে বললেন, ‘হে হাইযূম! অগ্রসর হও!’ এরপর সাহাবী দেখলেন, কারো আঘাতে পৌত্তলিক চিৎকাত হয়ে পড়ে গেছে। তার নাকে মুখে আঘাতের চিহ্ন! চেহারা রক্তাক্ত! দেখে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে তাকে চাবুক দিয়ে আঘাত করা হয়েছে।

একজন সাহাবী এক মুশরিককে মারার জন্যে দৌড়াতে শুরু করলে তার গলায় সাহাবীর তলোয়ার পৌছার আগেই মুশরিকের কর্তিত মস্তক মাটিতে গড়িয়ে পড়ে। সাহাবী বুঝতে পারেন, এই কাফেরকে অন্য কেউ হত্যা করেছে!

এক হালকা পাতলা আনসারী সাহাবী রাসূলের সুঠামদেহী চাচা হযরত আব্বাস ইবনে আবদুল মুত্তালিবকে গ্রেফতার করে রাসূলের সামনে উপস্থিত হন। আব্বাস বলেন, ‘আল্লাহর শপথ, আমাকে তো এই লোকটি কয়েদ করে নিয়ে আসেনি। আমাকে মুন্ডিত মস্তকের একজন লোক কয়েদ করে নিয়ে এসেছে! সুদর্শন সেই লোকটি একটি চিত্রল ঘোড়ার পিঠে আসীন ছিল। এখন তো সেই লোকটি এইসব লোকের মধ্যে দেখা যাচ্ছে না।’ আনসারী বললেন, ‘হে আল্লাহর রসূল, তাকে তো আমি গ্রেফতার করেছি।’ রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, আল্লাহ তায়ালা একজন সম্মনিত ফেরেশতার মাধ্যমে তোমাকে সাহায্যে করেছেন।'

আবুবকর ও আলী রাযিয়াল্লাহু আনহুকে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, আপনাদের একজনের সঙ্গে জিবরীল আলায়হিস সালাম এবং একজনের সঙ্গে মীকাঈল আলায়হিস সালাম রয়েছেন। আর ইস্রাফিল আলায়হিস সালামও বিশাল ফেরেশতা, যিনি ময়দানে এসেছেন।

মুসলমানদের সাহায্যে এসব ফেরেশতারা মাঠে নেমে আসার আগে মুশরিকদের সাহায্যের জন্য তাদের সাথে ছিল অভিশপ্ত শয়তান। সে সুরাকা ইবনে মালিকের রূপ ধরে ময়দানে ছিল। সে যখন দেখলো ধারাবাহিকভাবে একের পর এক ফেরেশতা নেমে আসছেন আকাশ থেকে তখন ছুটে পালাতে চাইল। কিন্তু হারেস ইবনে হিশাম তাকে ধরে ফেললেন। তিনি তো ভেবেছেন, লোকটি সুরাকা ইবনে মালেক। কিন্তু ইবলিস হারেসের বুকে প্রচন্ড জোরে ঘুষি মারল। তিনি মাটিতে পড়ে গেলেন। মুশরিকরা বলল, ‘সুরাকা কোথায় যাচ্ছ? তুমি কি বলো নাই যে, আমাদের সাহায্যে করবে, আমাদের কাছ থেকে দূরে থাকবে না?' সুরাকা রূপি ইবলিস বলল, আমি এমন কিছু দেখতে পাচ্ছি, যা তোমরা দেখতে পাওনা। আল্লাহকে আমার ভয় হচ্ছে, তিনি কঠোর শাস্তিদাতা! এই কথা বলে যুদ্ধের ময়দান ছেড়ে শয়তান সুদূর সমুদ্রে গিয়ে হাঁপ ছেড়ে বাঁচে সে আর জলেমদের মুখের উপর দ্রুত বন্ধ হয়ে যায় পৃথিবীর প্রতিটি কপাট।
সমাপ্ত

আপনিও হোন ইসলামের প্রচারক ইন শা আল্লাহ ’ লেখাটি শেয়ার করুন বন্ধুদের সাথে!

Post a Comment

0 Comments