কালেমা কয়টি ও কি কি?

কালেমা কয়টি ও কি কি?

যাবতীয় প্রশংসা আল্লাহর। দরুদ ও সালাম আল্লাহর রাসূল (সা) এর উপর। পরম করুণাময় ও অসীম দয়ালু আল্লাহর নামে শুরু করছি।

আমাদের দেশে ইসলামী ঈমান-আকীদার বিবরণের ক্ষেত্রে ‘পাঁচটি কালিমা’র কথা প্রচলিত আছে। এছাড়া ঈমানে মুজমাল ও ঈমানে মুফাস্সাল নামে দুইটি ঈমানের কথা আছে। কায়েদা, আমপারা, দ্বীনিয়াত ও বিভিন্ন প্রচলিত বই পুস্তকে এই কালিমাগুলি রয়েছে। এগুলিকে অত্যন্ত জরুরী মনে করা হয় এবং বিশেষভাবে মুখস্থ করা হয়। এই বাক্যগুলির অর্থ সুন্দর। তবে সবগুলি বাক্য এভাবে হাদীস শরীফে বর্ণিত হয় নি। এগুলিকে সব কুরআনের কথা বা হাদীসের কথা মনে করলে ভুল হবে।

(১) কালিমায়ে শাহাদত

কুরআন ও হাদীসে ইসলামী ঈমান বা বিশ্বাসের মূল হিসাবে দু ইটি সাক্ষ্য প্রদানের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে, যা আমাদের দেশে ‘কালিমা শাহাদত’ হিসাবে পরিচিত। এই কালিমায় আল্লাহর তাওহীদ এবং মুহাম্মাদ (সা) এর রিসালাতের সাক্ষ্য প্র দান করা হয়। প্রকৃতপক্ষে একমাত্র কালিমা শাহাদতই হাদীস শরীফে ঈমানের মূল বাক্য হিসাবে উল্লে খ করা হয়েছে। সালাতের (নামাযের) ‘তাশাহ্ হুদের’ মধ্যে বাক্যদ্বয় এভাবে একত্রে বলা হয়েছে:

أَشْهَدُ أَنْ لا إلا الله و أَشْهَدُ أنَّ مُحَمَّدًا عََبْدُهُ وَ رَسولُهُ

আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আল্লাহ ছাড়া কোনো মাবূদ (উপাস্য) নেই এবং আমি সাক্ষ্য প্রদান করছি যে, মুহাম্মাদ (সা) আল্লাহর
বান্দা ও রাসূল।”

এই ‘কালিমা’ বা বাক্যটি দুইটি বাক্যের সমন্বয়ে গঠিত।

প্রথম বাক্য: أَشْهَدُ أَنْ لا إلا الله

“আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আল্লাহ ছাড়া কোনো মাবূদ (উপাস্য) নেই।”
এ প্রথম বাক্যটির ক্ষেত্রে কোনো কোনো হাদীসে বলা হয়েছে:

لا إِلَهَ إِلا اللهُ وَحْدَهُ لا شَرِيْكَ لَهُ

“আল্লাহ ছাড়া কোনো মা’বুদ নেই, তিনি একক, তাঁর কোনো শরীক নেই।”

দ্বিতীয় বাক্য: و أَشْهَدُ أنَّ مُحَمَّدًا عََبْدُهُ وَ رَسولُهُ

“আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, মুহাম্মাদ (সা) আল্লাহর বান্দা ও রাসূল।
আযানের মধ্যে এ বাক্যদ্বয়কে পৃথকভাবে উল্লে খ করা হয়েছে। দ্বিতীয় বাক্যটির ক্ষেত্রে কোনো কোনো হাদীসে (أشهد) অর্থাৎ ‘আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি’ কথাটি পুনরাবৃত্তি না করে শুধুমাত্র ( وَ أَنَّ ) ‘এবং নিশ্চয়’ বলা হয়েছে। কোনো কোনো হাদীসে বাক্যদ্বয়ের শুরুতে (أشهد) বলা হয়নি, বরং বলা হয়েছে:

لا إِلَهَ إِلَّا اللهُ وَ أَنَّ مُحَمَّدًا رَسُولُ اللهِ

দ্বিতীয় বাক্যটির ক্ষেত্রে অনেক হাদীসে ( أَنَّ مُحَمَّدًا رَسُولُ اللهِ) ‘মুহাম্মাদ আল্লাহর রাসূল’ কথাটির পরিবর্তে ( أَنَّ مُحَمَّدًا عََبْدُهُ وَ رَسولُهُ) ‘মুহাম্মাদ আল্লাহর বান্দা ও রাসূল’ - বলা হয়েছে। এছাড়া কোনো কোনো হাদীসে ‘সাক্ষ্য প্রদান’ শব্দের পরিবর্তে ‘বলা’ শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে। এভাবে বিভিন্ন হাদীসে আমরা এ কালেমাটিকে নিম্নের বিভিন্ন রূপে দেখতে পাই (বুখারী, আস-সহীহ, ১/১২, ২৯, ৩/১২৬৭; মুসলিম, আস-সহীহ ১/৪৫, ৪৭, ৫৭, ৬১)

(১) প্রথম রূপ: أَشْهَدُ أَنْ لا إِلَهَ إِلَّا اللهُ و أَشْهَدُ أَنِّ مُحَمَّدًا رَسُولُ اللهِ
(২) দ্বিতীয় রূপ: أَشْهَدُ أَنْ لا إِلَهَ إِلَّا اللهُ و أَنِّ مُحَمَّدًا رَسُولُ اللهِ
(৩) তৃতীয় রূপ: أَشْهَدُ أَنْ لا إِلَهَ إِلَّا اللهُ وحْدَهُ لا شَرِيكَ لَهُ وَ أَنَّ مُحَمَّدًا عَبْدُهُ و رَسولُهُ
(৪) চতুর্থ রূপ: لا إِلَهَ إِلَّا اللهُ و أَنِّ مُحَمَّدًا رَسُولُ اللهِ
(৫) পঞ্চম রূপ: أَشْهَدُ أَنْ لا إِلَهَ إِلَّا اللهُ وَ أَنَّ مُحَمَّدًا عَبْدُهُ و رَسولُهُ

বিভিন্ন হাদীসে আমরা দেখতে পাই যে, সাহাবায়ে কেরাম ইসলাম গ্রহণের সময়ে এ উপরে উল্লিখিত এ সকল বাক্যের কোনো একটি পাঠ করে ইসলামের ছায়াতলে প্রবেশ করতেন। (বুখারী, আস-সহীহ ১/১৭৬, ৩/১২১১; মুসলিম, আস-সহীহ ১/৩০২, ৩/১৩৮৬; নাসাঈ, আস-সুনান ১/১০৯)

(২) কালিমায়ে তাইয়েবা

আমাদের দেশে কালিমা তাইয়েবা বা ‘পবিত্র বাক্য’ বলতে বুঝানো হয় তাওহীদ ও রিসালাতের একত্রিত ঘোষণা:

لا إله إلا الله محمّدٌ رسول اللهِ

কুরআন কারীমে এরশাদ করা হয়েছে:
“তুমি কি দেখ নি, কিভাবে আল্লাহ একটি উদাহরণ পেশ করেছেন: একটি ‘কালিমায়ে তাইয়েবা’ বা পবিত্র বাক্য একটি পবিত্র বৃক্ষের মত, তার মূল প্রতিষ্ঠিত এবং তার শাখা-প্রশাখা আকাশে প্রসারিত।” (সূরা ইবরাহীম: ২৪)

এ আয়াতের ব্যাখ্যায় আব্দুল্লাহ ইবন আব্বাস (রা) ও অন্যান্য মুফাস্সির থেকে বর্ণিত হয়েছে যে, এখানে ‘কালিমা তাইয়েবা’ বলতে ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু’ তাওহীদের এ বাক্যটিকে বুঝানো হয়েছে। (তাফসির ইবনে কাসির)

কিন্তু (লা ইলাহা ইল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ) দুইটি বাক্য একত্রিতভাবে কোনো হাদীসে কালিমা তাইয়েবা হিসাবে উল্লেখ করা হয়নি। আমরা দেখেছি যে, কালিমা শাহাদাতকে অনেক সময় “শাহাদাত” শব্দ উহ্য রেখে নিম্নরূপে বলা হয়েছে:

لا إِلَهَ إِلَّا اللهُ و أَنِّ مُحَمَّدًا رَسُولُ اللهِ

কিন্তু মাঝখানে (وَ أَنَّ) বাদ দিয়ে উভয় অংশ একত্রে

لا إله إلا الله محمّدٌ رسول اللهِ
এভাবে ‘কালিমা’ হিসাবে সহীহ হাদীসে কোথাও উল্লেখ করা হয়েছে বলে জানা যায় না। কোনো কোনো হাদীসে বর্ণিত হয়েছে যে, এভাবে এ বাক্যদ্বয় একত্রে আরশের গায়ে লিখা ছিল। এ হাদীসগুলি অত্যন্ত দুর্বল বা বানোয়াট। কোনো কোনো হাদীসে উল্লেখ করা হয়েছে যে, রাসূলুল্লাহ (সা) -এর ঝাণ্ডা বা পতাকার গায়ে লিখা ছিল:

لا إله إلا الله محمّدٌ رسول اللهِ

এ অর্থের হাদীসগুলির সনদে দুর্বলতা আছে। (হাইসামী, মাজমাউয যাওয়াইদ ৫/৩২১)

এখানে উল্লেখ্য যে, কালিমা তাইয়িবার দুটি অংশ পৃথকভাবে কুরআন কারীমে ও হাদীস শরীফে উল্লে খ করা হয়েছে। উভয় বাক্যই কুরআনের অংশ এবং ঈমানের মূল সাক্ষ্যের প্রকাশ। উভয় বাক্যকে একত্রে বলার মধ্যে কোনো প্রকারের অসুবিধা নেই ।
তাবেয়ীগণের যুগ থেকেই কালিমা শাহাদতের মূল ঘোষণা হিসাবে এ বাক্যটির ব্যবহার দেখতে পাওয়া যায়। কুরআন কারীমে ‘কালিমাতু তাকওয়া’ ‘তাকওয়ার বাক্য’ বলা হয়েছে (সূরা ফাতহ: ২৬) । এর ব্যাখ্যায় তাবিয়ী আতা আল-খুরাসানী (১৩৫ হি) বলেন: কালিমায়ে তাকওয়া হলো (লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ) ( তাফসিরে তাবারী)

(৩) কালিমায়ে তাওহীদ

কালিমায়ে তাওহীদ নামে আমাদের দেশে নিম্নের বাক্যটি প্রচলিত:

لا إلَهَ إلَّا أَنْتَ و احِدٌا لا ثَاني لَكَ مُحَمَّدٌ رَسولُ اللهِ إِمامُ المُتَّقينَ و رَسولُ رَبِّ العالَمينَ

এ বাক্যটির অর্থ সুন্দর। তবে এ বাক্যটির কোনোরূপ গুরুত্ব এমনকি এর কোনো প্রকারের উল্লেখ বা অস্তিত্ব কুরআন বা হাদীসে পাওয়া যায় না।

(৪) কালিমায়ে তামজীদ

কালেমায়ে তামজীদ হিসাবে নিম্নে র বাক্যটি প্রচলিত:

لا إَلَهَ آلَّا أَنْتَ نورًا يَهْديْ اللهُ لِنورِهِ مَنْ يَشَاءُ مُحَمَّدٌ رَسولُ اللهِ إِمامُ المُرْسَلينَ خاتَمُ النَّبيِّينَ

এ বাক্যটির অর্থও সুন্দর। কিন্তু এভাবে এ বাক্যটি বলার কোনো নির্দেশনা, এর কোনো গুরুত্ব বা অস্তিত্ব কুরআন বা হাদীসে পাওয়া যায় না।

(৫) কালিমায়ে রাদ্দে কুফর

কালেমায়ে রাদ্দে কুফর নামে কয়েকটি বাক্য প্রচলিত আছে, যেমন:

اللَّهُمَّ إِنِّى أَعوذُ بِكَ مِنْ أَنْ أُشْرِكَ بِكَ شَيْعًا و نُؤْمِنَ بِهِ و أَسْتَغْفِرُكَ مِمَّا أَعْلَمُ بِهِ وَ ما لا أَعْلَمُ بِهِ و أَتُوبُ و آَمَنْتُ وَ أَقُوْلُ أَنْ لا إِلَهَ إِلَّا اللهُ مُحَمَّدٌ رَسُولُ اللهِ

বাক্যগুলির অর্থ ভাল। কিন্তু বাক্যগুলি এভাবে কোনো হাদীসে পাওয়া যায় না এবং এই বাক্যের কোনো বিশেষ গুরুত্বও হাদীস দ্বারা প্রমাণিত নয়।

(৬) ঈমানে মুজমাল

ইমানে মুজমাল নামে প্রচলিত বাক্যটির অর্থ সুন্দর ও সঠিক। তবে এরূপ কোনো বাক্য কোনোভাবে কোনো হাদীসে উল্লেখ করা হয়নি।

(৭) ঈমানে মুফাস্সাল

ঈমানের পরিচয় দিয়ে রাসূলুল্লাহ (সা) বলেন:

أَنْ تُؤْمِنَ بِاللهِ وَ مَلائِكَتِهِ و كُتُبِهِ و رُسُلِهِ و اليَومِ الآَخِرِ و تُؤْمِنَ بِالقَدْرِ خَيْرِهِ و شَرِّهِ

“তুমি ঈমান আনবে আল্লাহর উপরে, তাঁর ফিরিশতাগণের উপরে, তাঁর কেতাবগুলির উপরে, তাঁর রাসূলগণের উপরে, শেষ দিবসের (আখেরাতের) উপরে, এবং তুমি ঈমান আনবে তাকদীরের উপরে: তার ভাল এবং তার মন্দের উপরে।” (মুসলিম, আস-সহীহ ১/৩৭; বুখারী, আস-সহীহ ১/২৭, ৪/১৭৯৩)

ঈমানের এ ছয়টি রুকন বা স্তম্ভের কথা কু রআন ও হাদীসে বারংবার উল্লেখ করা হয়েছে। লক্ষ্যণীয় যে, ‘ঈমানে মুফাস্সালের মধ্যে আখিরাতের বিশ্বাসকে পৃথক দুটি বাক্যাংশে প্রকাশ করা হয়েছে (ইয়াওমিল আখির) ও (বা’সি বা’দাল মাউত): শেষ দিবস ও মৃত্যুর পরে উত্থান। উভয় বিষয় একই।
সমাপ্ত

আপনিও হোন ইসলামের প্রচারক ইন শা আল্লাহ ’ লেখাটি শেয়ার করুন বন্ধুদের সাথে!

Post a Comment

0 Comments