(১) আল্লাহ তাআ’লার দৃষ্টিতে সবচাইতে বড় পাপ হচ্ছে আল্লাহর সাথে কোন কিছুকে শরীক করা।
(ক) ক্বুরআনুল কারীমে আল্লাহ তাআ’লা ইরশাদ করেছেন, হযরত লুক্বমান আ’লাইহিস সালাম তার ছোট্ট ছেলেকে অত্যন্ত আদরমাখা কন্ঠে উপদেশ দিয়ে বলেছিলেনঃ “ইয়া বুনাইয়্যা! লা তুশরিক বিল্লাহ.....”
অর্থঃ হে আমার প্রিয় বতস্য! তুমি আল্লাহর সাথে কোন কিছুকে শরীক করো না। নিশ্চয়ই শিরক হচ্ছে সবচাইতে বড় জুলুম (অত্যাচার)।” [সুরা লুক্বমানঃ ১৩]
☟
(খ) আল্লাহর সাথে শিরক করা অন্যায়ভাবে নিরপরাধ মানুষ খুন করা, যিনা-ব্যভিচারে লিপ্ত হওয়া, চুরি-ডাকাতি বা ছিনতাই করা, সুদ-ঘুষের চাইতেও মারাত্মক অপরাধ। শিরক একজন ব্যক্তির দুনিয়া ও আখেরাত নষ্ট করে দেয়।
মহান আল্লাহ তাআ’লা বলেন, “ফিতনাহ মানুষ হত্যার চাইতে জঘন্য।” [সুরা আল-বাক্বারাহঃ ১৯১]
এই আয়াতের তাফসীর সম্পর্কে আবুল আলিয়া, মুজাহিদ, আল-হাসান, যাহহাক, ইকরিমা, সাঈদ ইবনে জুবায়ের, কাতাদাহ (আল্লাহ তাদের সকলের প্রতি রহম করুন), ক্বুরআনের তাফসীরকারক হিসেবে প্রসিদ্ধ এই সমস্ত তাবেয়ীরা সকলেই বলেছেন যে, এই ফিতনার অর্থ হচ্ছেঃ “শিরক”।
অর্থাৎ এই আয়াতের উদ্দিষ্ট অর্থ হচ্ছে, শিরকের পাপ মানুষ খুন করারা চাইতেও বড়।
(২) যে ব্যক্তি শিরক করবে, আল্লাহ তার জন্য জান্নাত হারাম করে দিবেন, সে চিরকাল জাহান্নামে কঠিন শাস্তি ভোগ করতে থাকবে। মুশরেক কোনদিন জাহান্নাম থেকে বের হতে পারবেনা। যারা শিরক করবে, তাদের ভয়াবহ পরিণতি সম্পর্কে আল্লাহ তাআ’লা ক্বুরআনুল কারীমে যা উল্লেখ করেছেন নিন্মে তা সংক্ষেপে বর্ণনা করা হলোঃ
(ক) “যে ব্যক্তি আল্লাহর সাথে শিরক করবে, নিশ্চয়ই আল্লাহ তাকে কখনোই ক্ষমা করবেন না। তবে শিরকের চাইতে ছোট যে কোন অপরাধ তিনি যাকে ইচ্ছা তাকে ক্ষমা করে দেবেন।” সুরা আন-নিসাঃ ৪৮।
☟
(খ) “যে ব্যক্তি আল্লাহর সাথে শিরক করবে, নিশ্চয়ই আল্লাহ তার জন্য জান্নাত হারাম করে দিবেন এবং তার ঠিকানা হবে জাহান্নাম। আর এরূপ অত্যাচারী লোকদের জন্য কোন সাহায্যকারী থাকবে না।” [সুরা আল-মায়ি’দাহঃ ৭২]
☟
(গ) “আর যে ব্যক্তি আল্লাহর সাথে শিরক করল; সে যেন আকাশ থেকে ছিটকে পড়ল, অতঃপর মৃতভোজী কোন পাখী তাকে ছোঁ মেরে নিয়ে গেল অথবা, বাতাস তাকে উড়িয়ে নিয়ে কোন দূরবর্তী স্থানে নিক্ষেপ করল।” সুরা আল-হা’জ্জঃ ৩১।
(৩) যে সমস্ত লোকেরা দুনিয়াতে ঈমানের দাবী করবে, যারা বলবে আমরা আল্লাহকে বিশ্বাস করি, তাদের মধ্যে অধিকাংশ লোকই জেনে কিংবা না জেনে শিরকের মতো অমার্জনীয় পাপে লিপ্ত থাকবে। এটা আমার মনগড়া কোন কথা নয়, দেখুন আল্লাহ তাআ’লা কি বলেছেন, “যারা আল্লাহর উপর ঈমান আনে, তাদের মধ্যে অধিকাংশ লোকই (ঈমান আনার) সাথে সাথে শিরক করে।” [সুরা ইউসুফঃ ১০৬]
(৪) মুশরিক কাকে বলা হয়?
শিরক অর্থ কাউকে শরিক বা অংশীদার বানানো। যে ব্যক্তি শিরক করে, তাকে ‘মুশরিক’ বলা হয়। সাধারণত বাংলাতে ‘মুশরিক’ শব্দের অর্থ করা হয় অংশীবাদী। মুশরিক বলা হয় তাকে, যে কোন কিছুকে আল্লাহর একক, অদ্বিতীয় এবং অপ্রতিদ্বন্দ্বী সত্ত্বা, মর্যাদা বা ক্ষমতার সমান অথবা তার সাথে অংশীদার বলে মনে করে ও বিশ্বাস করে, অথবা দাবী করে। মুশরিক চির জাহান্নামী, সে কোনদিন জাহান্নাম থেকে বের হতে পারবেনা। অনন্তকাল সে জাহান্নামে কঠিন শাস্তি পেতে থাকবে।
উদাহরণঃ
হিন্দুরা তাদের মাটির তৈরী দেব-দেবীগুলোকে আল্লাহ তাআ’লার সমকক্ষ বলে বিশ্বাস করে, সুতরাং জাতিগতভাবে হিন্দুরা মুশরিক। মারেফাতে বিশ্বাসী অনেক অজ্ঞ সূফী, যারা নিজেদের মুসলমান বলেই মনে করে, কিন্তু তারা তাদের জিন্দা-মুর্দা পীর-ফকিরদেরকে আল্লাহ তাআ'লার সমান সম্মান, ভক্তি-শ্রদ্ধা ও ভয় করে, তাদেরকে সেজদাহ করে, তাদের কাছে দুয়া করে, বিপদে আপদে উদ্ধার করার জন্য নবী-রাসুল কিংবা অলি-আওলিয়াদের কাছে গায়েবী সাহায্য চায়, তাদেরকে আলেমুল গায়েব ও হাজির-নাযির মনে করে...এই সবগুলো কাজ ডাহা শিরক। যারা এইগুলো করবে তারা মুশরিকদের অন্তর্ভুক্ত হবে, যদিওবা তারা নিজেদেরকে মুসলমান বলে দাবী করে, যদিওবা তারা লোক দেখানো কিছু নামায-রোযা করে। খ্রীস্টানরা ঈসা আ'লাইহিস সালামকে আল্লাহর পুত্র বলে বিশ্বাস করে (নাউযুবিল্লাহি মিং যালিক), এদিক থেকে তারা আল্লাহর সত্ত্বার সাথে শিরকে লিপ্ত।
(৫) কেয়ামতের পূর্বে মুসলিমদের কোনো কোনো বংশ মূর্তি পূজা আরম্ভ করবে, আর কিছু সংখ্যক মুসলিম নামধারী লোক মুশরিকদের সাথে মিলে যাবে।
(ক) রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, “আমি আমার উম্মাতের ব্যাপারে পথভ্রষ্ট ইমাম বা নেতাদেরকে ভয় করছি। অচিরেই আমার উম্মাতের কোনো কোনো গোত্র বা সম্প্রদায় মূর্তি পূজায় লিপ্ত হবে, এবং আমার উম্মতের কতগুলো গোত্র মুশরিকদের সাথে যোগ দিবে।”’’ আবু দাউদঃ ৪২৫২, ইবনু মাযাহঃ ৩৯৫২, হাদীসটি সহীহ, শায়খ আলবানী।
☟
(খ) কেয়ামতের পূর্বে ‘লাত’ ও ‘উজ্জার’ পূজা এমনভাবে শুরু হবে যেইভাবে জাহেলিয়াতের সময় (অন্ধকার যুগে) প্রচলিত ছিল।
আয়িশাহ রাদিয়াল্লাহু আ’নহা হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লামকে বলতে শুনেছি, ‘‘রাত ও দিন শেষ হবে না, যতক্ষন না লাত ও উযযা দেবতার পূজা আবার শুরু করা হবে। এ কথা শুনে আমি (আয়িশাহ) বললাম, হে আল্লাহর রাসুল! পবিত্র কুরআনে মহান আল্লাহ নাযিল করেছেন, ‘‘তিনি তাঁর রাসুলকে পাঠিয়েছেন হিদায়াত ও সত্য দ্বীন সহকারে, সকল দ্বীনের উপর বিজয়ী করার জন্য, যদিও মুশরিকরা তা অপছন্দ করে।’’ (সুরা আত-তাওবাঃ৩৩) এই আয়াত নাযিলের পর আমি (আয়িশাহ) তো মনে করেছিলাম যে, এ প্রতিশ্রুতি পূরন করা হবে। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, ‘‘তা অবশ্যই হবে। তবে যতদিন আল্লাহ ইচ্ছা করবেন ততদিন পর্যন্ত তা বলবৎ থাকবে। অতঃপর তিনি এক মনোরম বাতাস প্রেরন করবেন। ফলে যাদের অন্তরে সরিষার দানা পরিমান ঈমান আছে তাদের প্রত্যেকেই মৃত্যুবরণ করবে। পরিশেষে যাদের মাঝে কোন কল্যাণ (অর্থাৎ, ঈমান) নেই তারাই শুধু বেঁচে থাকবে। অতঃপর তারা আবার পিতৃ-পুরুষদের ধর্মের (শিরকের) দিকে ফিরে যাবে।” [সহীহ মুসলিমঃ ৭১৯১ (৫২/২৯০৭)]
❖ শিরক তিন প্রকার
(১) শিরকে আকবর বা বড় শিরক।
এই শিরকে লিপ্ত হলে একজন ব্যক্তি মুশরেক হয়ে চির জাহান্নামী হয়ে যায়। উদাহরণঃ আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো কাছে দুয়া করা, গাইরুল্লার জন্য কোরবানি করা, মূর্তি পূজা করা, আল্লাহ ছাড়া অন্য কাউকে বিধান দাতা মনে করা, রাশিফল বা গণককে বিশ্বাস করা, যাদু করা ইত্যাদি।
☟
(২) শিরকে আসগার বা ছোট শিরক।
শিরকে আসগার হচ্ছে এমন পাপ যা শিরক, কিন্তু এই পাপে লিপ্ত হলে বান্দার ঈমান নষ্ট হয়ে মুশরিক বা চির জাহান্নামী হয় না এবং সে ইসলামের গন্ডি থেকে বের হয়ে কাফের হয়না। তবে এটা মারাত্মক একটা পাপ এবং কবীরা গুনাহ। যদিও বলা হচ্ছে ছোট শিরক, কিন্তু এই পাপ মানুষ খুন করা, জিনা করা, চুরি করার চাইতেও নিকৃষ্ট। এই পাপ থেকে তোওবা না করে মারা গেলে জাহান্নামে শাস্তি নিশ্চিত পাবে। তোওবা না করলে আল্লাহ এই গুনাহ মাফ করবেন না। তবে ছোট শিরকে লিপ্ত কোন ব্যক্তি নামাযী ঈমানদার হলে পাপের শাস্তির পরে জান্নাতে যেতে পারবে। উদাহরণঃ রিয়া বা লোক দেখানো ইবাদত করা, গাইরুল্লাহর নামে কসম করা।
☟
(৩) শিরকে খফী বা গোপন শিরকঃ
এই শিরক মানুষের বিভিন্ন কথা ও কাজে গোপন থাকে, কিন্তু যেই মানুষ এইগুলোতে লিপ্ত থাকে, সে নিজেও বুঝতে পারেনা যে শিরক করছে। এইজন্য একে গোপন শিরক বলে। উদাহরণঃ আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো উপর তাওয়্যাকুল (ভরসা) করা বা তাকে বেশি ভয় করা, রিয়া এক প্রকার গোপন শিরকের উদাহরণ।
সমাপ্ত
আপনিও হোন ইসলামের প্রচারক ইন শা আল্লাহ ’ লেখাটি শেয়ার করুন বন্ধুদের সাথে!
1 Comments
মসজিদে নামাজ পড়ার সময় কেউ সামনে থাকা অবস্হায় সিজদাহ করলে কি শিরক হবে? দয়া করে জানাবেন।
ReplyDelete