وَأَنْكِحُوا الْأَيَامَى مِنْكُمْ وَالصَّالِحِينَ مِنْ عِبَادِكُمْ وَإِمَائِكُمْ إِنْ يَكُونُوا فُقَرَاءَ يُغْنِهِمُ اللَّهُ مِنْ فَضْلِهِ وَاللَّهُ وَاسِعٌ عَلِيمٌ ﴿٣٢﴾
"তোমাদের মধ্যে যাদের স্বামী-স্ত্রী নেই, তাদের বিবাহ দাও[1] এবং তোমাদের দাস-দাসীদের মধ্যে যারা সৎ, তাদেরও।[2] তারা অভাবগ্রস্ত হলে, আল্লাহ নিজ অনুগ্রহে তাদেরকে অভাবমুক্ত করে দেবেন। [3] আর আল্লাহ প্রাচুর্যময়, সর্বজ্ঞ।" [সূরাহ আন-নূর, আয়াত : ৩২]
[1] أَيَامَى শব্দটি أَيِّم শব্দের বহুবচন। আর أَيِّم এমন মহিলাকে বলা হয়, যার স্বামী নেই। যার মধ্যে কুমারী, বিধবা ও তালাকপ্রাপ্তা সবাই শামিল। এমন পুরুষকেও أَيِّم বলা হয়, যার স্ত্রী নেই। আয়াতে অভিভাবকদেরকে সম্বোধন করে বলা হয়েছে যে, ‘বিবাহ দাও।’ ‘বিবাহ কর’-- এ কথা বলা হয়নি; যাতে সম্বোধন সরাসরি বিবাহকারীকে করা হত। এ থেকে জানা যায় যে, মহিলারা অভিভাবকের অনুমতি ও সম্মতি ছাড়া নিজে নিজে বিবাহ করতে পারবে না। যার সমর্থন হাদীসসমূহেও পাওয়া যায়। অনুরূপভাবে কেউ কেউ আজ্ঞাবাচক শব্দ থেকে দলীল গ্রহণ করে বলেছেন যে, বিবাহ করা ওয়াজেব। আবার কেউ কেউ মুবাহ ও মুস্তাহাব বলেও অভিহিত করেছেন। তবে যাদের বিবাহের শক্তি-সামর্থ্য আছে, তাদের জন্য বিবাহ সুন্নতে মুআক্কাদাহ; বরং কোন কোন অবস্থায় ওয়াজেবও হয়। আর এ থেকে একেবারে যে মুখ ফিরিয়ে নেয়, তাকে শাস্তির ভয় দেখানো হয়েছে। নবী (সাঃ) বলেন, ‘‘যে ব্যক্তি আমার সুন্নত হতে মুখ ফিরিয়ে নেবে, সে আমার উম্মতের মধ্যে নয়।’’ (বুখারী ৫০৬৩, মুসলিম ১০২০ নং)
[2] এখানে 'সৎ' বলতে ঈমানদারকে বুঝানো হয়েছে। এ বিষয়ে মতভেদ রয়েছে যে, মালিক বিবাহ দেওয়ার ব্যাপারে দাসীকে বাধ্য করতে পারে কি না? কেউ বাধ্য করার পক্ষে আবার কেউ তার বিপক্ষে। তবে ক্ষতির সম্ভাবনা থাকলে শরিয়তের দৃষ্টিতে বাধ্য করা বৈধ; অন্যথা অবৈধ। (আইসারুত তাফসীর)
[3] অর্থাৎ, শুধু দারিদ্র্য ও অর্থের অভাব বিবাহে বাধার কারণ হওয়া উচিত নয়। হতে পারে বিবাহের পর আল্লাহ তাআলা নিজ কৃপায় তার দরিদ্রতাকে ধনবত্তায় পরিবর্তন করে দেবেন। হাদীসে এসেছে যে, তিন ব্যক্তি এমন আছে, যাদেরকে আল্লাহ অবশ্যই সাহায্য করে থাকেন; বিবাহকারী, যে পবিত্র থাকার ইচ্ছা করে। লিখিত চুক্তিবদ্ধ দাস, যে চুক্তিকৃত অর্থ পরিশোধ করার নিয়ত রাখে। এবং আল্লাহর রাস্তায় জিহাদকারী। (তিরমিযীঃ জিহাদ অধ্যায়)
এক.
একটা সময় মানুষ কেন বিয়ে করে আর এটা না করলে কি সমস্যা এমন কিছু প্রশ্ন মনের মধ্যে ঘুরপাক খেতো। এমনকি আমি কখনো এই বিয়ের ঝামেলায় যাবো না এটাও ভাবতাম। কিন্তু সময়ের পরিক্রমায় আমি আজ বিবাহিত (আলহামদুলিল্লাহ)। তবে এর পেছনে রয়েছে চমৎকার কিছু অভিজ্ঞতা যা কারো কারো উপকারে আসতে পারে এ আশা রেখেই এই লেখা (ইনশা আল্লাহ্ তা’আলা)।
যখন থেকে দ্বীন বুঝতে শুরু করেছি তখন থেকেই বিয়ে নিয়ে একটু পজেটিভ হতে শুরু করলেও এ নিয়ে সিরিয়াস হতে একটু বেশিই সময় লেগেছে। আর এর পিছনে সামাজিকতা এবং প্রতিষ্ঠিত হওয়ার মতো দুটি জনপ্রিয় বিষয় দায়ী ছিলো। কারণ ছেলের বয়স কম হলে নাকি সামাজিকতা হারিয়ে যায় আর বউকে কি খাওয়াবে এই ভয়ে নাকি প্রতিষ্ঠিত হওয়া চাই। অথচ এর কোনটাকেই নির্দিষ্টভাবে সংজ্ঞায়িত করা হয় নাই। তাই অনেক সিরিয়াসনেস থাকা সত্ত্বেও একসময় ক্লান্ত হয়ে থেমে যেতে হয়। তাই বিয়ে নিয়ে চিন্তা-ভাবনা সেই অনার্স লাইফ (২০১৪-১৫) থেকে করলেও সিরিয়াস হতে হয়েছে ২০১৯ এসে। তবে আমার সিরিয়াসনেসকে আল্লাহ্ তা’আলা কবুল করেছেন। সাথে আরো দুটি ইচ্ছাও- একজন প্র্যাকটিসিং মুসলিমাহ ও প্রথম দেখা পাত্রী। আর এই বিয়েতে পরিবারের তারাই সবচেয়ে উপকারে এসেছে যাদেরকে আমি দ্বীনের বেসিকটা হলেও বুঝাতে পেরেছিলাম, সাথে সেই বিশেষ দুআটির কথা না বললেই নয়, ‘রব্বানা হাবলানা মিন আজওয়াজিনা..’। আল্লাহ্ আমাদের উভয়কে কবুল করুন, আমীন।
দুই.
সাধারণত আমাদের বিয়েগুলোতে কনে দেখা থেকে কবুল বলা পর্যন্ত নানান মানুষ নানান মত দিয়ে থাকেন। আমার ক্ষেত্রেও এর ব্যাতিক্রম হয়নি। অথচ দ্বীনদারিতাকে সামনে নিয়ে আসলে এতো কিছু ভাবতে হতো না। আর সিদ্ধান্ত নেয়াটাও হয়ে যেত খুব সহজ। বাবা-মা যেদিন প্রথম কনে দেখতে গিয়েছিল তখনও অনেকের প্রশ্ন ছিলো কেন বাবা-চাচারা দেখতে পারবে না, আবার সে কেন (মাহরাম-নন মাহরাম) সবার সামনে আসবে না ইত্যাদি। আর যেদিন আমি দেখতে গিয়েছিলাম সেদিনটা আমার কাছে ছিলো একটু ভিন্নরকম। একদিকে মা আর ফুফুর কাছ থেকে কনে সম্পর্কে পজেটিভ শুনে আমিও বেশ পজেটিভ হয়ে গিয়েছি। অন্যদিকে এখানে যদি ভুল সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলি তা আমার জীবনের উপর বড় প্রভাব ফেলবে এই ভয়ও পেয়েছি। তবে অল্প কিছুক্ষণের কথায় তার দ্বীনদারিতা সম্পর্কে ভালো ধারণা চলে এসেছিলো। আলহামদুলিল্লাহ।
পরবর্তীতে আমাকে দেখতে আসা, বিয়ের প্রথম ভাইবা দেয়াসহ বেশ কিছু পর্ব পেরিয়ে যখন বিয়ের তারিখটা নির্ধারণ হলো তখন থেকেই অনেকে ভাবতে শুরু করলো বউ কতটুকু সাজবে, গায়ে হলুদ হবে কিনা, কোন ড্রেসে আসবে ইত্যাদি নানান প্রশ্ন। শুরু থেকেই এ বিষয়ে আমি স্ট্রিক্ট থাকলেও ওদিক নিয়ে চিন্তিত ছিলাম। সে কি পারবে এতগুলো সামাজিকতা বর্জন করতে। কারণ আমাদের উভয়ের ফ্যামিলেতই কিছু লোক ছিলো যারা সামাজিকতাকে একটু বেশিই গুরুত্ব দেয়। তবে আল্লাহর নিকট অনেক শুকরিয়া যে সেও ছিল তার অবস্থান থেকে অনেক স্ট্রিক্ট। ফলশ্রুতিতে সামাজিকতার অসামাজিকতা তার নিজের উপর বেশি একটা প্রভাব ফেলতে পারেনি। তাই গায়ে হলুদের মহামারি, আর নিজেকে প্রদর্শনের আহামরি চেষ্টার কোনটাই তাকে স্পর্শ করেনি। অনেকে তো বিশ্বাসও করতে চায়নি নতুন বউ কালো বোরখায় আবৃত হয়ে স্বামীর বাড়িতে আসবে। আলহামদুলিল্লাহ।
তিন.
দ্বীনদার স্ত্রী পাওয়া একটা ছেলের জন্য কতোটা নিয়ামত তা আমার স্ত্রীর দ্বীনী জ্ঞান, চারিত্রিক সৌন্দর্যতা এবং তার দ্বীন প্র্যাকটিসটা কাছ থেকে না দেখলে হয়তো আমি ক্লিয়ার হতে পারতাম না (আলহামদুলিল্লাহ)। ওর যে বিষয়টি আমার খুব ভালো লাগে তা হলো স্বামী কিংবা স্বামীর পরিবারের কোন দোষ-ত্রুটি অন্যের কাছে বলে না বেড়ানো। যা একজন নন-প্র্যাকটিসিং মেয়ের কাছ থেকে কখনোই আশা করা যায় না। যদিও এসব বিষয় পাবলিকলি বলা আমি তেমন পছন্দ করি না, তবুও বলার কারণ- কোন ছেলে যেন তার অর্ধাঙ্গী পছন্দ করতে গিয়ে দ্বীনদার মেয়েই প্রাধান্য দেয়। কারণ একজন দ্বীনদার স্ত্রীই ভালো জানেন কিভাবে স্বামীর আনুগত্য করতে হয়, কিভাবে পরিবারে শান্তি বজায় রাখা যায়, কিভাবে সন্তান পরিচর্যা করতে হয় ইত্যাদি নানান বিষয়।
এবার বিয়ে নিয়ে আমার কিছু উপলব্ধি শেয়ার করি,
• বিয়ে আল্লাহর বিশেষ নিয়ামত। তাই এই বিষয়ে আল্লাহর নিকটই বেশি চাইতে হবে।
• সিরিয়াসনেস ব্যাতিত কোন কিছুতেই সফল হওয়া যায় না। তাই বিয়ের পূর্বশর্ত হিসেবে নিজেকে সিরিয়াস করতে হবে।
• দ্বীনদার স্বামী-স্ত্রী পাওয়া আল্লাহর বিশেষ দয়া। তাই এটা আল্লাহর নিকট বেশি বেশি চাইতে হবে।
• আমাদের সমাজে বিয়েতে নানারকম অপসংস্কৃতি বিদ্যমান রয়েছে। তাই এগুলো থেকে নিজেকে দূরে রাখতে সুন্নাহভিত্তিক বিয়ে সম্পর্কে স্পষ্ট জ্ঞান অর্জন করতে হবে।
• স্বামী/স্ত্রী পছন্দ করতে গিয়ে দ্বীনদারিতা প্রাধান্য দেয়াই জরুরী। কারণ যার দ্বীন সুন্দর সেই প্রকৃত সুন্দর। আর বাহ্যিক সৌন্দর্যতো টাকা হলেই পাওয়া যায়।
• একটা ছেলে কিংবা মেয়ে সবকিছুতে পারফেক্ট হবেনা এটাই স্বাভাবিক। তাই যে বিষয়গুলো মুখ্য নয় সেগুলো ছাড় দেয়াই বুদ্ধিমানের কাজ।
• অতিরিক্ত দেনমোহর আর শ্বশুর বাড়ি থেকে কিছু আশা করা ছোট মানসিকতার কাজ। তাই এসব চিন্তা মাথায় না রাখাই কল্যাণকর।
• একটা ছেলে একটা মেয়েকে বিয়ে করতে যাওয়া মানে তার সম্পূর্ণ দায়িত্ব নিয়ে নেয়া। আর ঐ মেয়ের ভরণপোষণও ঐ দায়িত্বের অন্তর্ভুক্ত। তাই সামর্থ্য ছাড়া বিয়ে নিয়ে আবেগি হওয়ার প্রয়োজন নেই। এক্ষেত্রে আল্লাহ’র নিকট সাহায্য চাওয়াই সহজ সমাধান।
• যোগ্য ছেলে মানে সবার বাড়ি-গাড়ি থাকতে হবে এমনটা নয়। পরিবারের ভরণপোষণের দায়িত্ব নিতে পারা ছেলেটাও যোগ্য হতে পারে যদি তার অন্য কোন সমস্যা না থাকে। আর অনেক বাড়ি-গাড়িওয়ালা ছেলেরা নেশা করতে করতে বহু আগেই অযোগ্য হয়ে আছে।
• বিয়ের গুরুত্বপূর্ণ একটি উদ্দেশ্য পরিবারে শান্তির বারিধারা প্রবাহিত করা। আর এটা কারো একার পক্ষে সম্ভব না। উভয়কেই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে হবে এবং আল্লাহর নিকট চাইতে হবে।
• বিয়ের পর স্বামী-স্ত্রী একে অন্যের দোষ-ত্রুটি খুঁজা কিংবা একজন অন্যজনকে ছোট করতে চাওয়া একটি শয়তানি আচরণ। তাই এসব থেকে সবসময়ই দূরে থাকতে হবে।
• স্বামী-স্ত্রী উভয়ই ভালো আচরণ প্রত্যাশা করে। আর নিজেদের মধ্যে সুসম্পর্ক বজায় রাখতে এর গুরুত্ব অনেক। অল্পতেই রেগে যাওয়া একটি মন্দ আচরণ।
• দ্বীনদার স্বামী-স্ত্রী পেয়েই আত্মতৃপ্ত হয়ে গেলে চলবে না। এটা পারিবারিক ও সামাজিক জীবনেও প্র্যাকটিস করতে হবে।
• একজন মুসলিম মানেই ইসলামের নিকট আত্মসমর্পণকারী। তাই স্বামী-স্ত্রী একে অপরকে ইসলামের নানাদিক নিয়ে নাসীহাহ্ দিবে। আর প্রত্যেকেই তা মনযোগ সহকারে শুনবে যদিও বিষয়টা তার জানা ছিলো। এতে যে ভালোবাসাটা সৃষ্টি হবে তা কেবল আল্লাহর জন্যই। যার পুরোটাই খাঁটি।
• স্বামী-স্ত্রীর মাঝে মনমালিন্য সৃষ্টি করতে পারাটা শয়তানের বড় ক্রেডিট। তাই এ বিষয়ে শয়তানকে কোন ফ্লোর দেয়া যাবেনা।
• বিয়ের পাত্র/পাত্রী সিলেকশনের পূর্বেই সবকিছু যাচাই-বাছাই করে নিতে হবে। বিয়ের পর কোন বিষয় নিয়ে আক্ষেপ করা বোকামি এবং তা সংসারে অশান্তি সৃষ্টির জন্য যথেষ্ট।
• আর নিজের বিয়েকে তাড়াতাড়ি ও সহজভাবে সম্পন্ন করতে অন্যের বিয়ের জন্য দোয়া ও সহজ করতে সহযোগিতা করা খুবই কার্যকরী একটি উপায়।
পরিশেষে এতটুকুই বলবো মুসলিম সমাজে বিয়ের গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা অনেক। তাই বিয়েটাকে যত সহজ করতে পারবো আমাদের জন্য ততই কল্যাণকর হবে। কারণ মুসলিম ছেলে-মেয়েগুলোর চারিত্রিক পবিত্রতা এর উপরই অনেকটা নির্ভর করছে। তাই ক্যারিয়ার, সামাজিকতা ও প্রতিষ্ঠিত হওয়ার জটিল চক্রে বিয়েটাকে যেন কঠিন না করে ফেলি। কারণ সমাজে বিয়ে যখন কঠিন হয়ে যাবে, তখন যিনা-ব্যাভিচার সহজ হয়ে যাবে। কেউ হয়তো ভাবছেন এতোটা সহজ না, একদম অভাবমুক্ত না হয়ে বিয়েতে যাওয়া বোকামি তাদের জন্য আল্লাহ তা’আলার পক্ষ হতে একটি স্মরণিকা,
"আর তোমরা তোমাদের মধ্যকার অবিবাহিত নারী-পুরুষ ও সৎকর্মশীল দাস দাসীদের বিবাহ দাও। তারা অভাবী হলে আল্লাহ নিজ অনুগ্রহে তাদেরকে অভাবমুক্ত করে দেবেন। আল্লাহ প্রাচুর্যময় ও মহাজ্ঞানী।" [সূরাহ আন-নূর, আয়াত : ৩২]
আল্লাহ্ আমাদের জন্য সহজ করুন। (আমিন)
সমাপ্ত
লেখাঃ আরিফুল ইসলাম দিপু (আল্লাহ্ তাকে উত্তম প্রতিদান দান করুন!)
আপনিও হোন ইসলামের প্রচারক ইন শা আল্লাহ ’ লেখাটি শেয়ার করুন বন্ধুদের সাথে!
0 Comments