তাওবাহ ফিরে আসার এক অবিশ্বাস্য উপায়

তাওবাহ ফিরে আসার এক অবিশ্বাস্য উপায়

মানুষ পথচ্যুত হবে এটা আল্লাহর দেয়া সিস্টেমের ভিতরেই। কারণ এমন এক দূর্দমনীয় কামনা, বাসনা, দূর্বলতা ও শক্তি এই মানুষকে দিয়েছেন আল্লাহ। নিজের পথ নির্ণয়ের এমন এক স্বাধীনতা তার স্রষ্টার কাছে থেকে পেয়েছে সে, যা ইচ্ছা তাই করার মত এক অসুরীয় শক্তি যৌবনে, প্রৌঢ়ে এমন কি বার্ধ্যক্যে সে ভোগ করে। যাতে পাপ ও স্খলনের অনেক দরোযা তার ইচ্ছার করাঘাতেই খুলে যায়। ফলে শ্বাস- প্রশ্বাসের দমেদমে, যাত্রার কদমে কদমে, হাত বাড়ানোর ক্ষণে বা কুক্ষণে তার পদস্খলনের সুযোগ থাকে প্রয়োজনের চেয়ে বেশি।

সে খাইতে চায়। অথচ দুনিয়ার খাবারের মাঝে আছে হারাম ও হালাল। সে ভোগ করতে চায়। ঐ ভোগের সামগ্রীতে থাকে জান্নাতি ছোঁয়া কিংবা জাহান্নামের দাউ দাউ করা আগুন। সে পেতে চায়। তার সেই কাংক্ষিত বস্তুতে বসে থাকতে পারে শয়তানের ছায়া ও প্রেতাত্মা, অথবা মালাইকার হাসিময় হাতছানি। এই খানেই হলো দূর্বল মানুষের অসহয়তা ও মূর্খতা। তার কাংক্ষার কাছে সে যেমন অসহায়, কোনটা তার জন্য ভালো তা নির্ণয়ে সে ততই মূর্খ। মাঝে মাঝে বরং মাতাল, অথবা পাগল।

এই অসহায় মানুষ যখন তার দূর্বলতায় তাড়িত হয়ে পথ হারায়ে ফেলে। ভালো ভালো কাজ গুলোকে ত্যাগ করে খারাপের মাঝে হাপসি খায়। হীরের সম্ভার ফেলে তুলে নেয় কাঁচের ধার বা ঠুনকো তোহফা। তখন হয়ত এই মানুষ মাথায় হাত দেয়। কিংবা শ্বাস অনেক দীর্ঘ করে ছেড়ে দেয় শুন্যের মাঝে। অথবা চোখে নোনা দরিয়ার সব বাঁধ খুলে দেয়। সে আবার সঠিক পথে ফিরে আসতে চায়। আবার হতে চায় আল্লাহর প্রিয়তম, সান্নিধ্য পেতে চায় ফেরেস্তার, কিংবা সাওয়াবের পসরা সাজাতে তৎপর হয় ভালো ভালো কাজ দিয়ে।

ইতিপূর্বের দীন ধর্মগুলোর কেও কেও বলে, পাপ করলে জীবনেও মাফ পাবেনা। আল্লাহ তোমার শাস্তি দেবেনই। কেও বলে কোন শাস্তিই হবেনা। তোমাদের গুনাহের বদলে ঈসা (আ) মরেছেন, কাজেই ভয় নেই। কিন্তু ইসলাম বলে না, পাপ তো পাপই, তবে পাপের বোঝা জীবনের তরীকে ডূবায়ে দিতে পারেনা। জীবনকে শানিত করে দিতে পারে যদি তুমি পাপের আঁচটা টের পাও। ভুল থেকে শিক্ষা নিয়ে আগের চেয়ে জীবন ফুলেল হতে পারে যদি তুমি ঐ ত্রুটি থেকে মুক্ত হতে পার।

এই সব কথা শুনে বিশ্বাস নাও হতে পারে; তাই আল্লাহ কুরআনে পাপ থেকে নিষ্ক্রান্ত, নিস্তার ও মোচনের পথ বলে দিয়েছেন খুব বিস্তারিত ও স্পষ্ট ভাবে। আল্লাহ বলছেন, “(আল্লাহর প্রিয় বান্দাহ সে) যে যিনা করেনা। কারণ যিনা করলে অনেক পাপের সম্মুখীন হতে হয়। (ছেলে ও মেয়ে পরষ্পরের পরিচয়ের গুনাহ, মুচকি হাসি ও চকিত চঞ্চলা দৃষ্টি বাণের গুনাহ, হাসি তামাসার কলঙ্কময় হিল্লোলের গুনাহ, ডেইটিং এর গুনাহ, এবং অতঃপর... এর গুনাহ)। আর কিয়ামতে তার যিনার শাস্তি অনেক গুণে বাড়িয়ে দেয়া হবে, এবং ঐ শাস্তির মাঝেই তাকে নিন্দিত অবস্থায় চিরদিন থাকতে হবে। তবে যে তাওবাহ করবে, ঈমান নবায়ন করবে, ভালো আমল করবে, আল্লাহ তাদের গুনাহ সমূহ ভালো দিয়ে পরিবর্তন করে দেবেন। নিশ্চয় আল্লাহ তাআলা ফিরে আসা পাপীদের গ্রহন করেন, এবং রহমের প্রবাহ দান করেন।” [সরা আলফুরক্বানঃ ৭০]

কুরআন ডেকে বলে, “ও মুমিনরা তোমরা সবাই আল্লাহর কাছে তাওবাহ করো, ফিরে আসো, যদি সফলতা চাও”। [সূরা নূরঃ ৩১] আল্লাহ আমাদের জানায়ে দেন যে, “তিনি ফিরে আসা পাপীদের অনেক ভালোবাসেন, তেমনই ভালো বাসেন যারা নিষ্কলুষ ও পবিত্র থাকে।” [আল বাক্বারাহঃ ২২২]

তিনি ক্ষুব্ধতার সাথে জানায়ে দেন, যে তাওবাহ করেনা, ফিরে আসেনা সে বড়ই অত্যাচারী, জালিম। [হুজুরাত, ১১]

আমাদের নবী (সা) তাঁর রবের কাছ থেকে (হাদীসে ক্বুদসী) বর্ণনা করেছেন। আমাদের আল্লাহ আমাদের বড় আদর করে বলছেনঃ “হে আদমের সন্তান, তুমি আমাকে ডেকেছো কি, ভালো আশা করেছো কি, আমি কোন কিছুর পরোয়া না করে তোমার যা ত্রুটি আছে, অমনি তা মাফ করে দেই। আদমের সন্তান, তোমার গুনাহ যদি আসমানের চাঁদোয়ায়ও যেয়ে পৌঁছে, এর পরেও আমার কাছে তুমি মাফ চাও, আমি কোন কিছুর পরোয়া না করেই তোমাকে মাফ করে দেবো। আদমের সন্তান, তুমি যদি পৃথিবী ভর্তি পাপ নিয়ে আমার কাছে আসো, এরপর শিরক মুক্ত থেকে আমার সামনে আসো, তা হলে আমিও পৃথিবী ভর্তি ক্ষমা নিয়ে তোমার কাছে আসবো। [তিরমিযি আনাস (রা.) থেকে।]

আল্লাহর কাছে ফিরে আসা, তাওবাহ করা, ক্ষমা চাওয়ার অনেক অনেক কথা কুরআন ও হাদীসে আল্লাহ ও তাঁর রাসূল (সা) বলেছেন। যা আমাদের শুধু আলোকিত করেনা, আমাদের মত যে সব পাপীরা অকূল দরিয়ার তীর হারা হয়েছি, পেয়ে যাই তীরের সন্ধান। কুরআনে বিভিন্ন স্থানে আল্লাহ আমাদের অনেক অনেক গল্প শুনিয়েছেন কিভাবে ভুলকারীরা ফিরে এসে ছিলেন।

প্রথম যে গল্পটা আল্লাহ আমাদের কাছে নিয়ে এসেছেন তা অনেক লম্বা, অনেক গভীর এবং অনেক অসহায়ত্বের আঁধারে আনে আশার আলো।

আল্লাহ আদম (আ) কে জান্নাতে দিয়েছিলেন। কিছুই বাকি রাখেননি তার জন্য। জান্নাত বলতে যা বুঝায় তার সব তিনি পেয়েছিলেন। শুধু একটা গাছের প্রতি ছিলো নিষেধাজ্ঞা। কিন্তু শয়তানের কুহকের কাছে আদমের (আ) নিষেধাজ্ঞার মূল মাক্বসাদ বুঝতে কিছুটা ভুল হয়ে যায়। তিনি ইজতিহাদ করলেন, এবং ঐ গাছ থেকে খেতে তাড়িত হলেন। সঙ্গে সঙ্গে তার জীবনের সব স্বাদ তিরোহিত হলো। রাজার পোষাক খুলে গেলো, আল্লাহর রেযামন্দীর উষ্ণ ভাষা শীতল হলো, ভুলের কাঁটা গলায় যেন মারাত্মকভাবে বিঁধে গেলো। এবং দুনিয়ায় চলে আসতে তিনি বাধ্য হলেন। তিনি গুমরে কাঁদতে থাকলেন। কিভাবে ক্ষমা চাইতে হয় তাও তিনি বুঝতে পারছেন না। রাজা বাদশার কাছে ভুল করলে হাত পা ধরে মাফ চাওয়া যায়। নানা রকম কথা বানানো যায়। কিন্তু ভালোবাসার আধারের কাছে ভুল করলে ক্ষমা চাওয়ার ভাষা মুখে আসেনা। আসে বুকের উঠানামা, ঠোঁট কামড়ে রক্তাক্ত করতে মন চায়, চুল ছিড়ে ফেলতে ইচ্ছে করে, নিজকে শেষ করে দিতে কাঁপতে থাকে হাত পা। আল্লাহই তাঁকে বাণী শিখায়েছেন, তিনি তাঁকে দিয়েছেন ভাষা, তাঁকে শিখিয়েছেন “আসমা”, বা নামের রহস্য। আদম এখন চাচ্ছেন কিভাবে মাফ চাইতে হয় সেটাও শিখতে। আল্লাহ রমহম করলেন। আদমকে তাওবাহএর ভাষা শেখালেন। সেই শেখানো দুয়া আদম বললেন, বললেন হাওয়া (আ) ও। মুখে বুকে কাঁপন, হাত হলো শুন্যের পানে ধাবমান, মাথা ধুলোয় ধুসরিত, “আমাদের রাব্ব, আমরা দুইজন আমাদের নিজেদের উপর জুলুম করে ফেলেছি, তুমি যদি না ক্ষমা কর, আর রহম না করো তাহলে আমরা ব্যর্থ হয়ে যাবো, ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে যাবো”। কুরআনেই গল্পটা সূরা আলবাক্বারা ও সূরা আলআ’রাফে একটু পড়ে দেখুন, মনটা নেচে উঠবে আনন্দে। আহ, আমাদের আল্লাহ কিভাবে মাফ চাইতে হয় তারও ভাষা শিখিয়ে দেন। তারপর ঐ আদম আর তাঁর স্ত্রী (আ) সে কথা বলার সাথে সাথেই আল্লাহ তাদের দিকে ফিরে আসেন, ফা তাবা আলাইহি, তাদের তাওবাহ ও ফিরে আসাকে গ্রহন করে নেন। তিনি তাওবাহ কবুল করেন, রহম দান করেন।

একজন ভুলকারীর মর্যাদা তার তাওবাহ কবুল করা ও ক্ষমা করায় শুধু ফিরে আসেনা, দরকার হয় তার পজিশনটা আগের মত থাকায়। এখানে আসে স্রষ্টার রহমের প্রশ্ন।

একবার কুরায়শরা এলো মহানবীর (সা) কাছে। বললো, মুহাম্মাদ, তুমি তোমার আল্লাহর কাছে দুয়া করো এই সাফা পাহাড়টা যেন সোনা হয়ে যায়। কাল সকালে এসে পাহাড়ময় সোনা দেখলেই আমরা সব ঈমান আনবো। মহানবী (সা) দুয়া করলেন। দুয়ার সাথে সাথেই জিব্রাইল (আ) নেমে এলেন। বললেন, আপনার রব্ব আপনাকে সালাম বলেছেন, এবং আপনাকে বলেছেন, “আপনি চাইলে আমি আপনাকে সাফা পাহাড় সোনা বানায়ে দেবো। কিন্তু তারপরে কেও যদি আপনাকে অস্বীকার করে তাহলে কিন্তু এমন শাস্তি দেবো যা পৃথিবীর আর কাওকে দেয়া হয়নি। অথবা আপনি চাইলে আমি আপনার জন্য তাওবাহ ও রাহমাহ এর দরোযা খুলে দেই”। আমাদের নবী বলেলেন, আমি চাই তাওবাহ ও রাহমার দরোযা। [তাবারানি, ইবনে আব্বাস থেকে।]
সমাপ্ত

লেখাঃ ডা. আব্দুস সালাম আজাদী (আল্লাহ্‌ তাকে উত্তম প্রতিদান দান করুন!)

আপনিও হোন ইসলামের প্রচারক ইন শা আল্লাহ ’ লেখাটি শেয়ার করুন বন্ধুদের সাথে!

Post a Comment

0 Comments