কুরআনের ৭টি আয়াত, যা আপনাকে নতুন করে ভাবতে বাধ্য করবে।

কুরআনের ৭টি আয়াত, যা আপনাকে নতুন করে ভাবতে বাধ্য করবে।

দুনিয়ার চাকচিক্য আর সম্পর্কের মায়ার বন্ধনে আঁটকে পড়ে আজ আমরা আখেরাতের জীবনের কথা ভুলতে বসেছি। ক্ষণস্থায়ী এই দুনিয়ার জীবনকে আমরা চিরস্থায়ী জীবন ভেবে নিয়েছি। যদিও আমরা মুখে আখেরাতের কথা স্বীকার করি কিন্তু কাজে কর্মে তেমন কোন লক্ষণ পরিলক্ষিত হয়না। ৫০/৬০ বছরের জীবন পেয়ে আমরা আজ এমন এক জীবনের কথা ভুলে গেছি, যে জীবনের শুরু আছে কিন্তু শেষ নেই। আমরা মানুষ জাতি কতই না বোকা ও অসচেতন।

আজ কুরআনের এমন কতিপয় আয়াত আলোচনা করবো, যা আমাদেরকে স্মরণ করিয়ে দিবে পরকালের কথা, দুনিয়ার নশ্বরতার কথা, দুনিয়াতে আমার-আপনার কি করা করা উচিত আর কি উচিত নয়। আয়াতগুলো নতুনভাবে জীবনের লক্ষ্য ও আমার-আপনার বর্তমান অবস্থা নিয়ে ভাবতে সাহায্য করবে।

১ম আয়াত

“অবশ্যই তোমাদের উপর তত্ত্বাবধায়ক নিযুক্ত আছে। সম্মানিত আমল লেখকবৃন্দ (কিরামান কাতিবিন)”। [সূরা ইনফিতর,আয়াত : ১০-১১]

প্রত্যেক মানুষের সাথেই দুজন ফেরেশতা আছে। যাদের আমরা কিরামান কাতিবিন বলে থাকি। প্রতিটা ভালো-মন্দ, ছোট-বড় পাপ ও পূণ্য তারা লিখে রাখেন। কখনো কি এভাবে ভেবে দেখেছেন, আপনি যে ঘুষ খাচ্ছেন, সুদ খাচ্ছেন, রাতের অন্ধকারে বা একলা ঘরে অশ্লীল ভিডিও দেখছেন, অন্যের অনুপস্থিতিতে গীবত করছেন তার সবই লেখা হচ্ছে আপনার আমলনামায়। রাত জেগে জেগে যে ছেলের সাথে/মেয়ের সাথে কথা বলছেন, পরিবারকে না জানিয়ে গোপনে বয় ফ্রেন্ড বা গার্লফ্রেন্ডের সাথে দেখা করছেন অথবা বন্ধুদের সাথে সিগারেটে টান দিচ্ছেন তার সবই কিন্তু লেখা হচ্ছে।

যদি বলি আল্লাহর কুরআনকে সত্য বলে বিশ্বাস করেন? আপনি বলবেন অবশ্যই করি। তাহলে আপনাকে বলছি, আল্লাহর কুরআনেই বলে দিয়েছে আপনার আমল নামা লেখা হচ্ছে সে কথা, তারপরও কেন পাপ থেকে বিরত হচ্ছেন না? এ কেমন বিশ্বাস? আসলে আপনি মিথ্যাবাদী, প্রতারক। নিজের সাথেই প্রতারণা করছেন। পারবেন হিসেব দিতে সেদিন, যেদিন আপনার হাতে আমলনামা ধরিয়ে বলা হবে পড়ো এবং জবাব দাও কেন এটা এটা করেছ?

২য় আয়াত

“মানুষের হিসাব-কিতাবের সময় নিকটবর্তী; অথচ তারা বেখবর হয়ে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে”। [সূরা আম্বিয়া,আয়াত : ১]

আপনি মনে করছেন আমার বয়স মাত্র ২০/২২, এখনো অনেক সময় আছে ভালো হওয়ার, ইবাদত বন্দেগী করার। অথচ আল্লাহ বলছেন সময় বেশি নেই খুব শীঘ্রই হিসাব দিতে হবে আমাকে-আপনাকে-সবাইকে। আখিরাতের অপরিমেয় সময়ের তুলনায় দুনিয়ার হায়াত অতি সামান্য। ৫০/৬০ বছর হায়াতের জন্য কিই না করছি, কত উপায় উপকরণ অর্জন করছি দুনিয়ার সুখের জন্য অথচ চাইলেই এই অল্প হায়াতকে যথাযথ কাজে লাগিয়ে সেই অফুরন্ত সময়ে পরকালকে অর্জন করা যায়। মনুষ্যজাতি কতই না গর্দভ। আসলে সবাই নগদে বিশ্বাসী, যদি দেখানো হতো আমাদের পূর্বপুরুষ যারা পাপ করে গেছে তারা কতটা কষ্টে আছে কবরে তবেই বিশ্বাস করতো এবং সঠিক পথে চলতো।

৩য় আয়াত-

“পাঠ কর তুমি তোমার কিতাব(আমলনামা)।আজ তোমার হিসাব গ্রহণের জন্যে তুমিই যথেষ্ট”। [সূরা বনী ইসরাঈল, আয়াত : ১৪]

আমল নামা দেয়া হবে হাতে আগেই বললাম। এটা এমন আমল নামা যাতে আপনার জীবনের কোন অংশ বাদ পড়েনি। অটোবায়োগ্রাফি তথা আত্মজীবনীতে ব্যক্তি শুধু তার সুন্দর অতীতকেই টেনে আনে। ব্যক্তি কখনো নিজের মন্দকাজ, মন্দ চরিত্রের কথা তুলে ধরে না। কিন্তু হাশরের মাঠে যে কিতাব আপনার হাতে দেয়া হবে তা পৃথিবীর কোন কিতাবের মতো নয়। অডিও, ভিডিও, টেক্সট সবই থাকবে এই কিতাবে। ব্যক্তি তার আমলনামা দেখে বিস্ময়ে বলবে “এটা কেমন কিতাব!যাতে ছোট বড় কিছুই বাদ যায়নি”। আর বলা হচ্ছে সেদিন ব্যক্তি নিজেই নিজের জন্য যথেষ্ঠ। কারণ সেদিন অন্য কাউকে সাক্ষী হিসেবে দাড় করানো হবে না।আপনিই আপনার বিরুদ্ধে একমাত্র সাক্ষী।

৪র্থ আয়াত-

“আজ আমি তাদের মুখে মোহর এঁটে দেব তাদের হাত আমার সাথে কথা বলবে এবং তাদের পা তাদের কৃতকর্মের সাক্ষ্য দেবে”। [সূরা ইয়াছিন,আয়াত : ৬৫]

আগের আয়াতে বলা হয়েছে নিজেই নিজের সাক্ষ্যের জন্য যথেষ্ঠ। সেটা কিভাবে তা এই আয়াতে দেখুন। মানুষের এটাই অভ্যাস যে সে অপরাধ স্বীকার করে না।যতক্ষণ না তার সামনে সমস্ত দলীল প্রমান পেশ করে ততক্ষণ সে জোরগলায় নিজেকে নিরপরাধ দাবি করে। তাকে দোষী সাব্যস্ত করার জন্য দলীল প্রমান আর সাক্ষীর প্রয়োজন হয়। হাশরের দিনও মানুষ অপরাধ অস্বীকার করবে। তখন আল্লাহ মানুষের মুখে সীল মেরে দিয়ে তার হাত, পায়ের জবান খুলে দিবেন। একটু কল্পনা করুন, যে হাত দিয়ে চুরির টাকা, সুদ-ঘুষের টাকা গ্রহণ করছেন, যে হাত দিয়ে হারাম মুখে তুলছেন, যে হাত দিয়ে অন্যের উপর আঘাত করছেন সেই হাত এই কাজ কর্মের সাক্ষ্য দিবে। একইভাবে পাও সাক্ষ্য দিবে।

আসলে আমাদের সেই অনুভূতি নেই।ভেতরটা আমাদের মরে গেছে।আমাদের বেশিরভাগেরই অন্তরে মোহর মেরে দেয়া হয়েছে।আমাদের চোখ আছে আমরা দেখিনা,কান আছে শুনিনা,অন্তর আছে অনুধাবন করিনা।

৫ম আয়াত-

“(হে আমার প্রভু)পূনরুত্থান দিবসে আমাকে লাঞ্ছিত করো না।যে দিবসে ধন-সম্পদ ও সন্তান সন্ততি কোন উপকারে আসবে না।(শুধু মুক্তি পাবে) যে সুস্থ অন্তর (পবিত্র অন্তর)নিয়ে আল্লাহর কাছে আসবে”। [সূরা শোয়ারা, আয়াত : ৮৮-৯০]

আজ যাদের জন্য, যাদের সুখের জন্য, যাদের রিজিকের জন্য অন্যায় ও অবৈধ পন্থা অবলম্বন করে অর্থ কড়ি উপার্জন করছেন সেদিন এদের কেউ আপনার একটা পাপও বহন করবে না। এরা আপনার কোন কাজে আসবে না, বরং আপনার শাস্তির কারণ হবে। আর আপনার সব অর্জিত সম্পদগুলো সেদিন সাপ, বিচ্ছুতে পরিণত হয়ে আপনাকে দংশন করবে আর বলবে “আমিই তোমার মাল, আমিই তোমার গুপ্তধন, আমিই তোমার সম্পদ”।

৬ষ্ঠ আয়াত

“তোমরা যা কর সে বিষয়ে অবশ্যই জিজ্ঞাসিত হবে”। [সূরা নাহল,আয়াত : ৯৩]

আপনি কি মনে করেছেন আজ আপনি যেভাবে স্বাধীন জীবন যাপন করছেন, যা ইচ্ছে তাই করছেন দুনিয়াতে কাউকে জবাবদিহি করতে হয়না, তেমনি পরকালেও কেউ আপনাকে আপনার কাজ কর্মের জন্য জিজ্ঞেস করবেনা? আল্লাহর কসম! প্রতিটা কাজের হিসেব দিতে হবে, প্রতিটা কাজের জন্য জিজ্ঞাসা করা হবে।

৭ম আয়াত-

“এরপর অবশ্যই সেদিন তোমরা নেয়ামত সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হবে”। [সূরা তাকাসুর, আয়াত : ৮]

মানুষের নিজ দেহ থেকে শুরু করে যতদূর পর্যন্ত চোখ যায় তার সর্বত্রই আল্লাহর নেয়ামত বিরাজিত। আল্লাহ যাকে যা দান করেন নি তাকে তার জন্য হিসাব দিতে হবে না, যাকে যা করার শক্তি দেননি তাকে তা করার আদেশও দেননি, তাই তাঁর থেকে হিসাব-নিকাশ অপ্রসাঙ্গিক। আল্লাহ আপনাকে যত নেয়ামত দিয়েছেন তার সব বিষয় সম্পর্কে আপনাকে অবশ্যই জিজ্ঞাসা করা হবে। আল্লাহর নেয়ামত পেয়ে আপনি শুকরিয়া আদায় করেছেন কিনা, তাঁর নেয়ামতের যথাযথ ব্যবহার করেছেন কিনা তা জিজ্ঞাসা করা হবে। আল্লাহ হাত দিয়েছেন হালাল ইনকামের জন্য হারাম কামানোর জন্য নয়, কারো উপর জুলুম করার জন্য নয়। আল্লাহ মানুষকে চোখ ও কান দিয়ে আল্লাহ কর্তৃক হালালকৃত বিষয় দেখার জন্য, শুনার জন্য এবং দেখে শুনে সঠিক সিদ্ধান্ত নেয়ার জন্য। অশ্লীল দৃশ্য দেখা বা অশ্রাব্য কথা শুনার জন্য নয়। আল্লাহ সৌন্দর্য দিয়েছেন বেশি করে আল্লাহর শুকরিয়া জ্ঞাপনের জন্য, অহংকার করার জন্য নয়। আল্লাহ কাউকে জ্ঞান শক্তি বাড়িয়ে দিয়েছেন আল্লাহর দ্বীনকে বক্তৃতা, লেখনী আর প্রচারের মাধ্যমে আল্লাহর দ্বীনকে সমুন্নত করার জন্য, দাম্ভিকতা প্রদর্শন কিংবা অন্যকে হেয় করা বা ছোট করার জন্য নয়। আল্লাহ আপনাকে ধন সম্পদ বাড়িয়ে দিয়েছেন তারই নির্ধারিত পথে ব্যয় করার জন্য, টাকার গরম আর অন্যকে তুচ্ছ জ্ঞান করার জন্য নয়।

কুরআনে এমন মোটিভেশনাল আয়াত অনেক আছে। আসলে আকল তথা বিবেকবান মানুষের জন্য আল্লাহর কালামের একটি আয়াতই যথেষ্ঠ। যারা নিজেদের অবস্থা পরিবর্তন করতে চায়, তাওবা করে সংশোধন হতে চায় তাদের জন্য আল্লাহর কালাম নাম্বার ওয়ান মেডিসিন।

আল্লাহ আমাদের সিরাতুম মুসতাকীমে পরিচালনা করুন, আমিন।
সমাপ্ত

লেখাঃ জান্নাত আরা (আল্লাহ্‌ তাকে উত্তম প্রতিদান দান করুন!)

আপনিও হোন ইসলামের প্রচারক ইন শা আল্লাহ ’ লেখাটি শেয়ার করুন বন্ধুদের সাথে!

Post a Comment

0 Comments